মরুর দেশের খেজুর চাষ করে নিজ গ্রামেই স্বাবলম্বী হয়েছেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌর শহরের স্বজন পুকুর এলাকার জাকির হোসেন (৪৭)। মরিয়ম, আজওয়া, খলিজি, মেডজল ও আম্বার—বিভিন্ন জাতের খেজুরে ভরপুর তার সখের খেজুর বাগান এখন এলাকায় বেশ আলোচনার বিষয়। প্রতিদিনই দূর-দূরান্ত থেকে উৎসুক মানুষ ভিড় করছেন তার বাগান দেখতে।
১৯৯৯ সালে জীবিকার তাগিদে কুয়েত যান জাকির। সেখানে ‘সুয়েব’ শহরে একটি মোটর গ্যারেজে চাকরি শুরু করেন। পরে নিজেই গ্যারেজের মালিক হন। কর্মজীবনের ফাঁকে ফাঁকে সুয়েব শহরের রাস্তাঘাট আর বাড়ির চারপাশে থাকা খেজুর গাছ দেখে অনুপ্রাণিত হন তিনি। সেই থেকেই স্বপ্ন দেখেন নিজ দেশে ফিরে খেজুর চাষের। অনলাইন আর প্রবাসে থাকা খেজুর চাষিদের কাছ থেকে শিখে নেন খেজুর চাষের পদ্ধতি।
২০১৭ সালে দেশে ফিরে পৌর শহরের স্বজন পুকুর এলাকায় নিজের ২০ শতক জমিতে রোপণ করেন খেজুরের বীজ। ধাপে ধাপে সেসব বীজ থেকে চারা হয়, আর চারাগুলো রূপ নেয় পরিপূর্ণ গাছে। অবশেষে ২০২২ সালে আসে কাঙ্ক্ষিত ফলন।
জাকির বলেন,
"২০১৭ সালে পৌর শহরের স্বজন পুকুর এলাকায় নিজের ২০ শতক জমিতে রোপণ করেন খেজুরের বীজ। সে বীজ থেকে চারা, চারা থেকে পরিপূর্ণ গাছ এবং ২০২২ সালে প্রথমবারের মতো দেখা মেলে কাঙ্ক্ষিত খেজুরের। তার এ সফলতা এলাকার সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন।"
এখন শুধু নিজে খেজুর ফলাচ্ছেন না, পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে গাছের চারা উৎপাদন করে বিক্রিও করছেন। দুই একর জমির উপর বিস্তৃত বাগানে বর্তমানে রয়েছে ১০ হাজারেরও বেশি বিক্রিযোগ্য খেজুর গাছের চারা।
জাকির হোসেন জানান,
“দুই একর জমিতে খেজুর গাছের বাগান ও চারা উৎপাদন করছি। নার্সারিতে বিক্রির উপযোগী ১০ হাজারেরও অধিক চারা রয়েছে। বীজ থেকে খেজুর গাছের চারা তৈরি করছি। সেই চারা বিক্রি করি আশপাশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। অনলাইনেও খেজুর গাছ প্রেমীদের চাহিদা রয়েছে। সেখানেও বিক্রি হয়। গত তিন বছরে প্রায় ৪০ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছি।”
শুরুর দিকে ২০ শতক জমিতে লাগানো ১৯টি গাছের মধ্যে এবার ১৪টি গাছে ফল এসেছে। আশা করছেন প্রায় ২০ মণ খেজুর পাবেন।
তিনি বলেন,
“এসব খেজুর এখনো পরিপক্ব হয়নি। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা কেজি দর পেলেও ১০ লাখ টাকার খেজুর বিক্রি করতে পারবো।”
২০২২ সালে মাত্র দুটি গাছে ফল ধরেছিল, সেখান থেকে শুরু হয়ে প্রতিবছরই ফলনের পরিমাণ বাড়ছে। কিছু ফল স্থানীয়দের খেতে দিয়েছেন, আবার কিছু ফল থেকে বীজ করে নতুন চারা তৈরি করেছেন।
জাকির বলেন,
“খেজুর শুরুতে সবুজ রঙের থাকে। ধীরে ধীরে রং পরিবর্তন হয়ে প্রথমে হলুদ তারপর গাঢ় লালচে রং ধারণ করবে। আগস্টের শেষ দিকে বাজারজাত করার উপযোগী হয়ে উঠবে এ খেজুর।”
বাজারে বর্তমানে দুই বছর বয়সী প্রতিটি চারা এক হাজার টাকা দামে বিক্রি করছেন। কলম চারার দাম ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। শহরের বাসিন্দাদের জন্য প্লাস্টিক ড্রামে চারা তৈরি করছেন ছাদে রোপণের উপযোগী করে।
তিনি বলেন,
“যারা এক সময় হাসাহাসি করেছেন তারা এখন টাকা দিয়ে চারা কিনছেন। যারা চারা কিনেছে এরমধ্যে কয়েকজনের গাছে ফল ধরেছে।”
জাকির এখন খেজুর চাষে পুরোপুরি দক্ষ। বীজ থেকে চারা তৈরি, কলম করা, ডাল ছাঁটাই, পরিচর্যা, ফল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ—সবই এখন তার নখদর্পণে। তিনি বলেন,
“আমাদের ধারণা খেজুর মরুর দেশের ফল। বিষয়টি তা নয়। খেজুর গাছ সব ধরনের মাটিতে হয়। খেয়াল রাখতে হবে জমি থেকে পানি নিষ্কাশনের সুব্যবস্থা আছে কিনা। তবে বেলে-দোঁআশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী।”
বীজ প্রস্তুতের বিষয়ে তিনি জানান,
“বালি-ছাই-গোবর ও কম্পোস্ট সার মিশিয়ে কয়েকদিন রেখে দিয়ে পরে জমিতে দিতে হবে। খেজুর থেকে প্রাপ্ত বীজ ৪০-৪৮ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখতে হয়। পরে ট্রেতে বীজ রোপণ করতে হয়। নিয়মিত পরিচর্যা করতে হয়। এভাবে ৪ সপ্তাহের মধ্যে বীজ থেকে চারা গজাবে। কিছুদিন পর ওই চারা প্লাস্টিকের প্যাকেটে তুলে রাখতে হয়। তারপর আবার তা মাটিতে রোপণ করতে হয়।”
পঞ্চগড় থেকে চারা কিনতে আসা তাহেরুল ইসলাম বলেন,
“পরিচিত একজনের কাছে জাকিরের সন্ধান পাই। তারপর মুঠোফোনে যোগাযোগ করি। ইতোমধ্যে জমি প্রস্তুত করেছি। ২০টি চারা কিনে নিয়ে যাচ্ছি।”
খেজুরের খাদ্যগুণ, জনপ্রিয়তা এবং আমদানি নির্ভরতা নিয়ে জাকির বলেন,
“এত সুন্দর পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ এ ফল। যা প্রতিদিন বিশেষ করে রমজান মাসে লাখ লাখ টাকার খেজুর আমাদের আমদানি করতে হয়। অথচ আমাদের দেশে খেজুর চাষের দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। আমি চেষ্টা করছি আগামী দশ বছরের মধ্যে দেশের প্রত্যেকটি গ্রামে এ খেজুর গাছের চারা রোপণ করতে। রপ্তানি করতে না পারি যেন খেজুর আর আমদানি করতে না হয় সে লক্ষ্যেই কাজ করছি। ইতিমধ্যে এলাকার মানুষদের উদ্বুদ্ধ করেছি, সাড়াও পাচ্ছি বেশ।”
ফুলবাড়ী উপজেলা (ভারপ্রাপ্ত) কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ শাহানুর রহমান বলেন,
“জাকিরের খেজুর বাগান পরিদর্শন করেছি। কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাকে সার্বিক পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। খেজুর চাষে এ অঞ্চলের কৃষিতে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। তিনি খুব ভালো একজন কৃষি উদ্যোক্তা। জাকির যেভাবে খেজুর চাষাবাদ করেছেন এভাবে খেজুর চাষাবাদ করে লাভবান হওয়া সম্ভব।”