যারা মিলাদুন্নবির উৎসবকে ঈমানের অঙ্গ বলে আকীদা পোষণ করেন এবং জাঁকজমকের সাথে মিলাদুন্নবির ‘জলসা—জুলূস’ করেন তারা নবির প্রতি ভক্তি-ভালোবাসা প্রদর্শনের জন্যই তা করে থাকেন। নবিভক্তি তো অবশ্যই প্রশংসনীয়, কিন্তু তাদের কি চিন্তা করা উচিত নয় যে, ভক্তি-মহব্বতের দাবি কী? এবং নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মর্যাদা কী?
হায়, ভক্তি-মহব্বতের দাবিদাররা যদি তা জানত!
এই মুবারক সময়ের পূর্ণ বরকত লাভের জন্য অপরিহার্য হলো, এসব ক্ষেত্রে ভক্তি-মহব্বত প্রদর্শন করতে গিয়ে স্বয়ং নবীজীর শরীয়তের আহকাম ও বিধান যেন কোনোভাবেই লঙ্ঘিত না হয়।
কিন্তু দুঃখজনক হলো, বর্তমানে এক শ্রেণীর জাহেল ও মূর্খ বিভিন্ন বিদআত ও হারাম কাজ দ্বারা এই মাহফিলকে কলুষিত করছে।
মিলাদ-মাহফিলে ঢোল-তবলা, গান-বাজনা এবং নারী-পুরুষের নাচানাচি ও অবাধ মেলামেশার মতো ঘৃণ্য ও হারাম কর্মকাণ্ড হতে দেখা যাচ্ছে। অথচ এসব কাজকর্ম থেকে যারা বাধা দেয় তাদেরকে মিলাদ বিরোধী আখ্যা দেওয়া হয় এবং এগুলো পরিহারের ব্যাপারে ভ্রূক্ষেপ করা হয় না। এসব ভণ্ড নবিভক্তদের শক্ত হাতে প্রতিরোধ করা অবশ্য কর্তব্য। অন্যথায় মীলাদ মাহফিলই হয়ে যাবে ইসলামবিরোধী কাজের আখড়া। যে পর্যন্ত এইসব মাহফিলকে হারাম কাজ থেকে পাকসাফ না করা হবে এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের আদব ও মর্যাদা রক্ষার ব্যবস্থা না করা হবে সে পর্যন্ত আমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সন্তুষ্টি অর্জন করতে পারব না। মিলাদুন্নবির মাহফিলগুলো দিন দিন এমনভাবে আদব-লেহাজশূন্য হতে চলেছে যে, তাতে শুধু যে রহমতের ফেরেশতাদের আগমন বন্ধ থাকে তাই নয়; বরং এসব মাহফিলের উদ্যোক্তা, আয়োজক ও অংশগ্রহণকারী সকলেই আল্লাহর গযব ও রাসূলের অসন্তুষ্টির উপযুক্ত হয়ে থাকে।
আফসোসের ব্যাপার হলো, এসব গর্হিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে না কোনো প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়, আর না নরমে বা গরমে এগুলোকে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়। ধর্মীয় মহলে এ বিষয়ে নীরবতার সবচেয়ে বড় কারণ হলো— ইল্লা মাশাআল্লাহ— উদরপূর্তির ধান্দা। কেননা এইসব রসম-রেওয়াজ প্রতিরোধ করতে গেল এখানটাতেই চোট লাগে।
আমরা মনে করে থাকি, এসব অনৈসলামিক ও শরীয়তগর্হিত কার্যকলাপের প্রতিবাদ করা হলে জলসা-জুলূসে আমাদের ধুম-ধড়াক্কা বক্তৃতা বন্ধ হয়ে যাবে এবং চাঁদার উপার্জনে ভাটা দেখা দেবে, তাই নিজেদের আর্থিক সুবিধা এবং দলীয় স্বার্থে আমরা মীলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পবিত্রতা ও মর্যাদাকে বিনষ্ট করছি।
আল্লাহর ওয়াস্তে রিসালাতের মর্যাদা ও পবিত্রতাকে সকল ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে মনে করে নিজেদের কর্মকাণ্ডকে সংশোধন করুন।
প্রশাসনের দায়িত্ব
এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনকে নীরব দর্শক হয়ে থাকা চলবে না; বরং এসব বিষয়ের প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কোনো সরকারি ব্যক্তির সামান্য অবমাননা করা হলে প্রশাসন তাকে শায়েস্তা করার সব রকম ব্যবস্থা করে থাকে কিন্তু যখন উরস ও মীলাদের নামে মতলববাজ লোকেরা নাচ-গানের এবং গাঁজা ও নেশার আসর জমিয়ে তোলে; এবং মেলা বসিয়ে আওলিয়ায়ে কেরামের শিক্ষা ও আদর্শের খোলাখুলি বিরুদ্ধাচরণ করে, তখন প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ নেয় না; বরং তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে। তাদের বিবেক কীভাবে এতে সায় দেয়? এসব ধর্ম-বণিককে কি শায়েস্তা করা প্রশাসনের ধর্মীয় দায়িত্ব নয়?
উরস উপলক্ষে আওলিয়ায়ে কেরামের মাজারে উপস্থিত হওয়ার উদ্দেশ্য হলো, কুরআন তিলাওয়াত করা এবং তাদের পবিত্র শিক্ষা ও আদর্শের আলোচনা শুনে সে অনুযায়ী জীবন ও কর্মকে সজ্জিত করা। তদ্রূপ মীলাদুন্নবীর জলসা-জুলূস নাত পাঠ, রাসূলের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের আলোচনা এবং শরীয়তসম্মত পন্থায় আনন্দ করার জন্যই আয়োজিত হয়ে থাকে। কিন্তু আফসোস, আল্লামা ইকবালের কথায়—
حقيقت خرافات ميں كهو گئ + يہ امت روايات ميں كهو گئ
‘হাকীকত হারিয়ে গেছে গোমরাহীর অন্ধকারে। উম্মত আজ দিশেহারা রসম-রেওয়াজের আবর্তে’।
দুর্ভাগ্যক্রমে আজ মুসলিম উম্মাহ দু’টি বড় দলে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। একদল বলে, মীলাদুন্নবী হারাম ও বিদআত। আর অন্যদল মীলাদের নামে বিভিন্ন হারাম কাজে লিপ্ত। বিদআত ও রসম-রেওয়াজকে মীলাদের অঙ্গীভূত করে এর পবিত্রতাকে তারা বিনষ্ট করে ফেলেছে।
আমরা মিলাদ ও সীরাতের নামে মুসলমানদেরকে দুই দলে বিভক্ত করে দিয়েছি। একদল শুধু মিলাদের আহ্বায়ক, অন্যদল সীরাত-প্রচারক।
মিলাদভক্ত সীরাত থেকে কেটে পড়ে, আর সীরাতপ্রেমী মীলাদকে নাজায়েয আখ্যা দেয়। তাই সময়ের দাবি হলো, সকল প্রান্তিকতা পরিহার করে সঠিক পথে ফিরে আসা।
আল্লাহর ওয়াস্তে বুদ্ধি-বিবেক ব্যবহার করুন— যদি মিলাদ না হত, তাহলে সীরাত কোত্থেকে আসে; আর যদি সীরাতের আলোচনাই না থাকে তবে মিলাদের উদ্দেশ্যই বা কীভাবে পূরণ হয়? মিলাদের বয়ান ও সীরাতের আলোচনা দুটোই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের স্মরণ। উভয়টিই এক প্রদীপের আলো। মিলাদকে বিদআত ও হারাম মনে করা যেমন উচিত নয়, তেমনি মিলাদের নামে গর্হিত কার্যকলাপের অনুপ্রবেশ ঘটানোও ঠিক নয়।
মিলাদ রাসূলের আবির্ভাবের আনন্দের নাম। এ মজলিসে শ্রদ্ধা ও মহব্বতের সঙ্গে অযু অবস্থায় শামিল হলে খোদার কসম, এটি সর্বোত্তম ইবাদত। মিলাদের জলসা-জুলূস ও মাহফিলগুলোতে সীরাতের আলোচনা করা এবং শ্রোতাদেরকে আকায়ে নামদার মাহবুবে কিবরিয়া সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুরত ও সীরাতের সৌন্দর্য, মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্য শোনানো এবং তাঁর ইশক ও মহব্বতের গীত গাওয়া প্রত্যেক মুসলিমের বৈশিষ্ট্য হওয়া উচিত। কেননা, এর মধ্যেই গোটা মুসলিম উম্মাহর সফলতার রহস্য লুকায়িত এবং এটাই এখন সবচেয়ে বড় ধর্মীয় প্রয়োজন। মিল্লাতে ইসলামের ওয়ায়েজ ও মুবাল্লিগরাই যদি মিলাদ ও সীরাতের মতো দুটি মৌলিক বিষয়কে ভিন্ন করে দেন তবে সাধারণ মুসলিম জনগণের নিকট হক কথা পৌঁছবে কীভাবে?
ওয়ায়েজ ও মুবাল্লিগণ যদি তাদের দ্বীনের পয়গাম ও রাসূলের সম্মান বহাল রাখতে চান, তাহলে তাদের দায়িত্ব হলো, যথাসাধ্য যাবতীয় শরীয়তবিরোধী ও বিদআতী কর্মকাণ্ডের মোকাবেলায় সর্বাত্মক জিহাদ শুরু করা।
প্রশাসনের দায়িত্ব হলো, মিলাদ মাহফিলগুলোর পবিত্রতা রক্ষায় এগিয়ে আসা এবং ঈদে মিলাদুন্নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে নাচ-গান ও অন্যান্য ভিত্তিহীন কার্যকলাপের হোতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা, যাতে জলসা-জুলূসের পরিবেশ সব ধরনের গর্হিত কায়াকলাপ থেকে মুক্ত ও পবিত্র থাকে।
[লেখক ঈদে মিলাদুন্নবিকে শরীয়তসম্মত বলে যে দাবি করেছেন সেটার সাথে আমরা একমত নই। তবে সমস্ত বিদআত ও রসম-রেওয়াজ থেকে দূরে থাকার যে আহ্বান তিনি জানিয়েছেন তার সাথে আমরা একমত এবং এ জন্যই লেখাটা আমরা পত্রস্থ করেছি। রেজভী ভাইগণ যদি তাদের নিজেদের মানুষের লিখিত এ কথাগুলো মনোযোগের সঙ্গে ভেবে দেখেন তাহলে সম্ভবত অবস্থার কিছুটা উন্নতি হবে।]
(লেখকের ‘মীলাদুন্নবী’ নামক রচনা থেকে গৃহীত ও অনূদিত)
সূত্র: মাসিক আল কাওছার