উপমহাদেশের আধুনিক শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে আনতে স্যার সৈয়দ আহমদ প্রতিষ্ঠিত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান শিরোধার্য। উপমহাদেশে আধুনিক শিক্ষার সূচনা ও বিকাশে যে ক’টি প্রতিষ্ঠান এবং মনীষী চিরস্থায়ী প্রভাব রেখেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম নাম স্যার সৈয়দ আহমদ খান এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় (এএমইউ)। ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানরা যখন রাজনৈতিক ও শিক্ষাগতভাবে পশ্চাৎপদ, তখন তিনি এমন এক আলোকবর্তিকা জ্বালান, যার আলো আজও হাজারো শিক্ষার্থীকে পথ দেখায়।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের পর ব্রিটিশ শাসনের প্রতি মুসলমানদের সম্পর্কে দুর্ভাবনা ও অবিশ্বাস গভীর হয়। মুসলমান সমাজ শিক্ষা, রাজনীতি এবং প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। এ প্রেক্ষিতে উদয় হন সমাজ সংস্কারক ও দার্শনিক স্যার সৈয়দ আহমদ খান। তাঁর লক্ষ্য ছিল পিছিয়ে পড়া মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জাগানোÑ শিক্ষার মাধ্যমে, যুক্তিবাদ এবং আধুনিক চেতনার মাধ্যমে। ১৮৫৮ সালে তিনি মোরাদাবাদে আধুনিক ইতিহাসচর্চার একটি বিদ্যালয় খোলেন এবং ১৮৬৪ সালে গাজীপুরে ‘সায়েন্টিফিক সোসাইটি’ গঠন করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ করে জনগণের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। এর মধ্য দিয়েই আলিগড় আন্দোলনের বীজ রোপিত হয়। ফলে প্রতিষ্ঠানটিকে একটি সমাজ জাগরণী মঞ্চও।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘আলিগড় আন্দোলন’ ছিল একটি শিক্ষামূলক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ, যার মূল লক্ষ্য ছিল মুসলমানদের আধুনিক শিক্ষায় অগ্রসর করে সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করা। এই আন্দোলনের মাধ্যমে একটি শিক্ষিত, যুক্তিবাদী ও সংস্কারমুখী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্থান ঘটে, যা পরবর্তীতে উপমহাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
১৮৬৯ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান তাঁর পুত্র সৈয়দ মাহমুদকে ক্যামব্রিজে পড়াশোনার জন্য পাঠান এবং নিজেও ইংল্যান্ড গমন করেন। সেখানে তিনি অক্সফোর্ড ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গঠন ও শিক্ষাপদ্ধতি ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এই ভ্রমণ তাঁর চিন্তাজগতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনে। তিনি বুঝতে পারেন, মুসলমানদের উন্নতির জন্য ধর্মীয় শিক্ষা যথেষ্ট নয়, আধুনিক বিজ্ঞান, সাহিত্য ও যুক্তিবাদকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অভিমানী মুসলিম নেতৃত্ব যখন ইংরেজি বর্জনের মাধ্যমে সরকারি-বেসরকারি চাকরি থেকে বিছিন্ন হয়ে পড়ে তখন স্যার সৈয়দ আহমদের শিক্ষা আন্দোলন আলোক বর্তিকা হয়ে দাঁড়ায় ।
১৮৭৫ সালে আলিগড়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ। এটি ছিল আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ১৮৭৭ সালের ৮ জানুয়ারি ভাইসরয় লর্ড লিটনের হাতে এর আনুষ্ঠানিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হয়। এই কলেজ পরিচালনার জন্য তিনি ব্রিটিশ ও ভারতীয় উভয় দিক থেকে অর্থনৈতিক ও নৈতিক সমর্থন আদায় করেন। ইংরেজ শিক্ষাবিদ থিওডর বেক, স্যার থমাস আর্নল্ডসহ অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি একাডেমিক কর্মকা-ে যুক্ত হন। প্রতিষ্ঠানটির লক্ষ্য ছিল মুসলিম সমাজের আত্মবিশ্বাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা এবং একটি নতুন শিক্ষিত নেতৃত্ব তৈরি করা। মোহামেডান অ্যাংলো-ওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠার সময় ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সমাজে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল প্রবল। অনেক ধর্মীয় নেতাই এটিকে ধর্মচ্যুতি হিসেবে দেখেছিলেন। স্যার সৈয়দ আহমদ খান এই বিরোধিতাকে মোকাবেলা করে বোঝাতে চেষ্টা করেন যে ইসলাম ও আধুনিক বিজ্ঞান একে অপরের পরিপন্থী নয়, বরং পরিপূরক। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষার জগতে একটি বিপ্লব সৃষ্টি করে। ফলে ভ্রান্তি নিরসন হতে থাকে।
১৮৮৬ সালে তিনি মোহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন, যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটে। পরে এই সংগঠন মুসলিম লীগ গঠনে ভূমিকা রাখে। স্যার সৈয়দ নিজেও ১৮৭৮ সালে রাজকীয় আইনসভায় সদস্য মনোনীত হন এবং ১৮৮৮ সালে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত হন।
১৯২০ সালে ভারতীয় আইন পরিষদের একটি আইনের মাধ্যমে এমএও কলেজকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় রূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এর ফলে এটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে ওঠে, যেখানে আইন, বিজ্ঞান, চিকিৎসা, সাহিত্যসহ বিভিন্ন অনুষদ চালু হয়। এএমইউ অচিরেই দক্ষিণ এশিয়ায় এক প্রভাবশালী শিক্ষাকেন্দ্র হয়ে ওঠে, যা শিক্ষার পাশাপাশি রাজনীতি, সংস্কৃতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে।
১৯৬৭ সাল থেকে এই বিশ্ববিদ্যালয় একটি আইনি জটিলতায় ভুগছিল। প্রশ্ন ছিল এই বিশ্ববিদ্যালয় সংখ্যালঘু মর্যাদা তবে কি পাবে না? ১৯৬৭ সালে পাশা আজিজ মামলায় এই প্রতিষ্ঠান তার সংখ্যালঘু মর্যাদা হারায়। তারপরও ১৯৮০ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আইন করে এই মর্যাদা পুরো প্রতিষ্ঠিত করলেও আদালতের রায় তা টেকেনি। পরবর্তীকালে এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে গেলে ৫৭ বছর পর সুপ্রিম কোর্টের সংবিধান বেঞ্চ এই মর্মের আয়োজন যে, সরকারি সাহায্য পেলেই কোনো প্রতিষ্ঠান তার সংখ্যালঘু মর্যাদা হারায় না। সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্য যে সমস্ত মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন মাননীয় সুপ্রিম কোর্ট তা হলো সংখ্যালঘুদের দ্বারা প্রদত্ত জমি ও অর্থ দিয়ে যদি সার্বিকভাবে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা নিতে পারে তাহলে সেটি সংখ্যালঘু মর্যাদা অধিকারী। মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের ৩০ নম্বর ধারার যে ব্যাখ্যা দিয়েছে তা মাইলফলক হয়ে থাকবে। এই রায় সংখ্যালঘু সমাজের হাজার হাজার প্রতিষ্ঠানের স্বপক্ষে যাবে।
আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য ও পরিকাঠামো ইন্দো-ইসলামিক ঐতিহ্যের প্রতিফলন। এটা বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ মৌলানা আজাদ লাইব্রেরি, জামে মসজিদসহ একাধিক প্রতীকী স্থাপনা আছে এখানে। প্রতিষ্ঠানটি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য উন্মুক্ত। শিক্ষার পাশাপাশি গবেষণা, সামাজিক সচেতনতা এবং সংস্কৃতিচর্চায় এটি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে অনন্য একটি প্রতিষ্ঠান।
এএমইউ থেকে অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি শিক্ষালাভ করেছেন, যাঁরা পরে উপমহাদেশের রাজনীতি, আইন, সাহিত্য ও প্রশাসনে গৌরবজনক অবদান রেখেছেন। যেমন: লিয়াকত আলী খান, পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, ড. জাকির হুসেন, ভারতের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, যদিও সরাসরি ছাত্র ছিলেন না, তিনি এই আন্দোলনের আদর্শে প্রভাবিত ছিলেন, নওয়াব ওয়াইদ আলি খান, সইয়্যিদ সুলতান আহমদ, বিশিষ্ট বিচারপতি ও কূটনীতিক।
আজকের এএমইউ প্রায় ১২০০ একর জমির ওপর বিস্তৃত এবং এর ১৩+ অনুষদ ও ১০০টিরও বেশি বিভাগ রয়েছে। এর অধীনে রয়েছে জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজ, জাকারিয়া বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ফ্যাকাল্টি অফ থিওলজি, ল স্কুল, বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিভাগ ইত্যাদি। ২০১৪ সালে ঞরসবং ঐরমযবৎ ঊফঁপধঃরড়হ জধহশরহম অনুযায়ী এএমইউ ছিল বিশ্বের শীর্ষ ২০টি উদীয়মান বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায়।
আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় শুধুমাত্র একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান মাত্র নয়, এটি একটি আদর্শ, একটি আন্দোলনের নাম, যা শিক্ষার আলোকে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে নতুন জীবনের পথে চালিত করেছে। স্যার সৈয়দ আহমদ খানের দৃষ্টিভঙ্গি আজও আলিগড়ের প্রতিটি শিক্ষার্থীর আত্মা ছুঁয়ে যায়। অন্তর্ভুক্তি, আধুনিকতা, ঐতিহ্য এবং সংস্কারের এক অপূর্ব সংমিশ্রণে গঠিত এই প্রতিষ্ঠান আজও প্রাসঙ্গিক, প্রভাবশালী এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যা যুগ যুগ ধরে আলোকিত সমাজ গঠনে আলোর মশাল জ্বালিয়ে যাবে। এই বিশ্ববিদ্যালয় শুধু অতীতের গর্ব নয়, ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও।
লেখক: আইনবিদ, কলামিস্ট, মানবাধিকার ও সুশাসন কর্মী।