logo
ads

পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিমান হারানো: ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশকাল: ২৩ জুলাই ২০২৫, ১২:৫১ পি.এম
পাকিস্তানের কাছে যুদ্ধবিমান হারানো: ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্পে প্রতিক্রিয়া ও প্রভাব

ভারতীয় রাফাল যুদ্ধবিমান || ছবি: এএফপি

ভারতের উত্তরাঞ্চলের আকালিয়া কালান গ্রামে যুদ্ধবিমানের গর্জন নতুন কিছু নয়। কারণ, কাছেই রয়েছে একটি বিমানঘাঁটি। তবে ৭ মে ভোরবেলা যেটা শোনা গেল, সেটা ছিল আলাদা—অস্বাভাবিকভাবে তীব্র এবং অচেনা। শুধু ইঞ্জিনের শব্দ নয়, সঙ্গে ছিল বিস্ফোরণের প্রতিধ্বনিও। শব্দ যত কাছে আসছিল, গ্রামবাসীরা ঘুম ভেঙে আতঙ্কিত হয়ে উঠছিলেন। তারা বাইরে গিয়ে দেখেন, আগুনে মোড়া একটি গোলা মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে কাছের এক মাঠে আছড়ে পড়েছে।

ভেঙে পড়া বস্তুটি যে একটি যুদ্ধবিমান, তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। প্রত্যক্ষদর্শী গ্রামবাসীরা জানান, এতে দুইজন পথচারীর মৃত্যু হয়। ভারতীয় বিমানবাহিনীর দুই পাইলট দুর্ঘটনার আগে প্যারাসুটে লাফিয়ে পড়েন এবং পরে তাদের আহত অবস্থায় আশপাশের মাঠ থেকে উদ্ধার করা হয়।

যদিও ভারত সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু স্বীকার করেনি, মে মাসে পাকিস্তানের সঙ্গে চার দিনের এক সংঘাতে বেশ কয়েকটি যুদ্ধবিমান হারিয়েছে বলে জানা যায়। পাকিস্তান দাবি করে, তারা তিনটি রাফালসহ মোট ছয়টি ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ভারত এই দাবি অস্বীকার করলেও, বিদেশি সামরিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ভারতের অন্তত পাঁচটি বিমান—including একটি রাফাল—ধ্বংস হয়েছে। যদিও ভারতীয় কর্মকর্তারা সুনির্দিষ্ট সংখ্যা জানাতে নারাজ, তারা স্বীকার করেছেন কিছু বিমান হারানো হয়েছে। তারা এখন ইঙ্গিত দিচ্ছেন যে, এই ক্ষতির পেছনে প্রযুক্তিগত ত্রুটি নয়, বরং ছিল কৌশলগত ভুল।

এই স্বীকারোক্তি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, পাকিস্তানের প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী চীন। ইতিহাসে এই প্রথম, চীনের তৈরি উন্নত যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্রের মুখোমুখি হয়েছে পশ্চিমা ও রুশ প্রযুক্তি। তাইওয়ানকে কেন্দ্র করে ভবিষ্যৎ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চীন একই ধরনের অস্ত্র ব্যবহারের সম্ভাবনা থাকায় আমেরিকা ও তার মিত্র দেশগুলোও এই সংঘাতকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে।

প্রাথমিক বিশ্লেষণে পাকিস্তানের চীনা জে-১০ যুদ্ধবিমান এবং পিএল-১৫ আকাশ থেকে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের শ্রেষ্ঠত্বই ফলাফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রেখেছে বলে ধারণা করা হয়। ভারত সম্ভবত এসব প্রযুক্তিকে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেয়নি। এমনও বলা হচ্ছে, চীন পাকিস্তানকে আগাম সতর্কতা এবং ‘রিয়েল-টাইম’ লক্ষ্যবস্তুর তথ্য দিয়ে লড়াইয়ের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।

পরবর্তীতে ভারতীয় বাহিনীর সাফল্য এলেও, প্রথম রাতের যুদ্ধ পরিকল্পনাতেই বড় ত্রুটি ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। এই ঘটনার সবচেয়ে সাম্প্রতিক এবং আলোচিত বাঁকটি আসে জুন মাসে। সেসময় ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে জাকার্তায় ভারতের প্রতিরক্ষা অ্যাটাশে ক্যাপ্টেন শিবকুমারের একটি বক্তব্য সম্প্রচার হয়। তিনি বলেন, ভারত কিছু যুদ্ধবিমান হারিয়েছে কারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বিমানবাহিনীকে পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আঘাত করতে নিষেধ করেছিল। বরং প্রথম রাতে নির্দেশ ছিল শুধু ‘জঙ্গি’ ঘাঁটিতে হামলা চালানোর। ক্যাপ্টেন কুমার বলেন, ‘ক্ষতির পর আমরা কৌশল পরিবর্তন করি এবং তাদের সামরিক স্থাপনাগুলোতে আক্রমণ করি।’

মে মাসের শেষের দিকে ভারতের চিফ অব ডিফেন্স স্টাফ (সিডিএস) জেনারেল অনিল চৌহানও একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে প্রথম রাতে কৌশলগত ভুলের কথা স্বীকার করেন। তিনি বলেন, পরবর্তী দুদিনে ভারত সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে যুদ্ধপদ্ধতি পরিবর্তন করে এবং তখন তাদের বিমানগুলো দূর থেকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে সক্ষম হয়। ভারত পরে আরও সফল হয়, যখন তাদের ক্ষেপণাস্ত্র পাকিস্তানের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভেদ করে সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে।

বিশ্লেষকদের মতে, ভারত প্রথম দিন রাফালে ‘মিটিওর’ দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র যুক্ত করেনি—সম্ভবত এই ধারণায় যে, পাকিস্তান এমন তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাবে না কিংবা পাকিস্তানের বিমান এসবের নাগালের বাইরে থাকবে।

আরও একটি ব্যাখ্যা হলো—ভারতের যুদ্ধবিমানগুলোতে ইলেকট্রনিক জ্যামিং, আপডেটেড সফটওয়্যার এবং প্রাসঙ্গিক ‘ডেটা’ ছিল না, যা পাকিস্তানের নতুন অস্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা গড়তে সক্ষম হতো। আরও বড় একটি সমস্যা ছিল—যুদ্ধের সময় ‘মিশন ডেটা’ সংগ্রহ ও ব্যবহারের ঘাটতি। যার ফলে পাকিস্তান সহজেই ভারতীয় হামলার পরিকল্পনা শনাক্ত করে, তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য তাদের নিজস্ব যুদ্ধবিমান ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থার সঙ্গে ভাগ করে নিতে পেরেছিল।

ক্যাপ্টেন শিবকুমারের বক্তব্য অনুযায়ী, রাজনৈতিক নেতাদের কৌশলগত সীমাবদ্ধ নির্দেশনার কারণেই যদি যুদ্ধবিমানগুলো দুর্বল অবস্থায় পড়ে, তবে এর দায়ভার বর্তায় মোদী সরকারের ওপর। পাকিস্তানের সঙ্গে আগের সংঘাতে ভারত উত্তেজনা এড়িয়ে চলার নীতিই হয়তো তখনও অনুসরণ করেছিল। কিন্তু এতে পাকিস্তানের নতুন সক্ষমতাকে আমলে নেওয়া হয়নি। এই বিষয়টি এখন বিরোধী দলের দাবিকে আরও জোরালো করছে যে সরকার ঘটনা ‘ধামাচাপা’ দেওয়ার চেষ্টা করছে। কংগ্রেস মুখপাত্র জয়রাম রমেশ বলেন, ‘কেন প্রধানমন্ত্রী সর্বদলীয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করতে এবং বিরোধীদের আত্মবিশ্বাসে নিতে অস্বীকার করছেন? কেন সংসদের বিশেষ অধিবেশনের দাবি প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে?’

এই সংঘাতের প্রভাব ভারতীয় প্রতিরক্ষা ক্রয়ের ওপরও পড়েছে। চলতি বছর ১১৪টি যুদ্ধবিমান কেনার জন্য বহু প্রতীক্ষিত দরপত্র আহ্বানের প্রস্তুতি চলছে। এই প্রতিযোগিতায় ফ্রান্সের ড্যাসল্ট রাফাল, সুইডেনের সাব, এবং মার্কিন বোয়িং ও লকহিড মার্টিন রয়েছে। তবে সামরিক কর্মকর্তাদের একাংশ মনে করেন, রাফাল প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। কিছু কর্মকর্তার অভিযোগ, ড্যাসল্ট রাফালের সফটওয়্যারের সোর্স কোড ভারতকে দিচ্ছে না, ফলে ভারতীয় বাহিনী বিমানটিকে প্রয়োজনমতো কাস্টমাইজ করতে পারছে না। অন্যদিকে, চীনা কূটনীতিকেরা এই সুযোগে রাফালের সমালোচনা করে বিভিন্ন দেশে নিজেদের প্রযুক্তি বিক্রির চেষ্টা করছে।

ড্যাসল্ট কর্তৃপক্ষ মিশর, ইন্দোনেশিয়া, কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বর্তমান ও সম্ভাব্য গ্রাহকদের আশ্বস্ত করতে চায়, তবে তারা ভারত সরকারকে ক্ষুব্ধ করতে চাইছে না বলেই এখনো প্রকাশ্যে মুখ খুলছে না। ড্যাসল্ট কতটা তদন্তে অংশ নিতে পেরেছে, তাও পরিষ্কার নয়। তবে ড্যাসল্ট চেয়ারম্যান এরিক ত্রাপিয়ের বলেন, পাকিস্তানের রাফাল ভূপাতিত করার দাবি ‘একেবারেই অসত্য’। ১১ জুন প্রকাশিত এক ফরাসি ম্যাগাজিনে তিনি বলেন, ‘সম্পূর্ণ বিবরণ জানা গেলে, বাস্তবতা অনেককে অবাক করে দিতে পারে।’ তাঁর মতে, রাফাল ‘বর্তমানে চীনের দেওয়া যেকোনো অস্ত্রের চেয়ে অনেক ভালো।’

 

তবে চাপের মুখে রয়েছে ফ্রান্স সরকারও। ফরাসি সংসদ সদস্য মার্ক শাভেন্ত ভারতের একটি রাফাল হারানো নিয়ে সরকারকে লিখিত প্রশ্ন জমা দিয়েছেন। তিনি জানতে চান, রাফালের ‘স্পেকট্রা’ ইলেকট্রনিক-ওয়ারফেয়ার সিস্টেম কেন পাকিস্তানের পিএল-১৫ ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত বা জ্যাম করতে ব্যর্থ হলো। তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন, ভবিষ্যতের রাফালে আপগ্রেডেড স্পেকট্রা থাকবে কিনা এবং ফ্রান্স ইলেকট্রনিক যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা নতুন যুদ্ধবিমান তৈরি করছে কি না।

অন্যদিকে, আকালিয়া কালান গ্রামসহ আশপাশের এলাকা তাৎক্ষণিকভাবে যে মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে, তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। বিস্ফোরণে মাথায় আঘাত পেয়ে নিহত রাজ কুমার সিং রেখে গেছেন তার স্ত্রী, দুই সন্তান এবং একজন অসহায় ৭০ বছর বয়সী মাকে। তারা এখনো পর্যন্ত কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি, এমনকি কোনো সরকারি প্রতিনিধি বা রাজনীতিবিদের সঙ্গেও তাদের যোগাযোগ হয়নি। এক গ্রামবাসীর ভাষায়, ‘এই দুর্ঘটনার খবর চাপা দিতে চায়’ কর্তৃপক্ষ।

[পুনর্লিখিত ও ভাবানুবাদকৃত]

dainikamarbangla

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ