logo
ads

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি ও মানবিক জাগরণ

ফাইজুস সালেহীন

প্রকাশকাল: ২৩ জুলাই ২০২৫, ০১:০৮ পি.এম
মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি ও মানবিক জাগরণ

ফাইল ছবি

স্কুলের আঙিনা থেকে আগুনে ঝলসে যাওয়া শরীর নিয়ে আট-নয় বছরের শিশু কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে এসেছে। তার ইউনিফর্ম পুড়ে দগ্ধ চামড়ার সঙ্গে মিশে গেছে। মর্মান্তিক এ দৃশ্য দেখে সহ্য করার মতো নয়। পাশে দাঁড়িয়ে মানুষ স্তম্ভিত-বেদনার্ত। হয়তো কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন তারা। এই ভিডিওচিত্রে সয়লাব সামাজিকমাধ্যম। জানি না কোন মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন এই শিশুটি। কে জানে, কোথায় কোন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অবর্ণনীয় কষ্টে কাতর শিশুটিকে। ওকে খুঁজে কি পেয়েছেন উদ্বিগ্ন পিতামাতা! এখন কেমন আছে ছোট শিশুটি? এমনই আরও অনেক শিশু দগ্ধ শরীর নিয়ে কাতরাতে কাতরাতে বেরিয়ে আসে স্কুলের গেটের বাইরে।

১৯৭৩ সালের ভিয়েতনামের রাস্তায় কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসা সেই নগ্ন নাপাম বালিকার ছবির কথা মনে পড়ছে। নিউইয়র্ক টাইমসে সেই ছবি ছাপা হলে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ববিবেক। মাইলস্টোন বিপর্যয়ে ঝলসে যাওয়া আমাদের শিশুরাও হয়ে উঠেছে গভীর বেদনার একেকটি জ্বলন্ত প্রতিচিত্র। শিক্ষয়িত্রী মেহেরিন নিজের জীবন-মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আগুনের ভেতর থেকে বের করে এনেছেন। ওদের বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু নিজে বাঁচতে পারেননি। শিক্ষকরা তো এমনই হয়ে থাকেন। কোমলপ্রাণ ছেলেমেয়েদের অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করত হয়তো আরেক দল নিকৃষ্ট মানুষ।

উত্তরা মাইলস্টোন স্কুলে ঘটে যাওয়া সোমবারের বিমান দুর্ঘটনা গোটা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে বেদনা-বিক্ষোভে। হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ, কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী এবং চোখের পলকে দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠা আগুনে ঝলসে যাওয়া কোমলমতি ছেলেমেয়েদের ছোটাছুটির ভয়াবহ চিত্র কেউ সহজে ভুলবে না। দগ্ধ শিশুদের আর্তনাদ, দিশাহারা শিক্ষক, মৃত্যু পথযাত্রী শিশু ও কিশোরের গোঙানি, সন্তানের খোঁজে দিশাহারা পিতামাতার চোখেমুখে সীমাহীন উদ্বেগ- সব মিলিয়ে জন্ম দেয় এক তীব্র বিষাদময় দৃশ্যপটের।

এই শোকাবহ ট্র্যাজেডি কেবল একটি দুর্ঘটনা নয়, এটি আমাদের রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা, নাগরিক নিরাপত্তা এবং দুর্যোগে দায়িত্বশীল আচরণের প্রকৃত রূপ উন্মোচন করেছে। তবে আশার কথা, এই ঘটনার মধ্যেও উঠে এসেছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসাধারণ মানবিক তৎপরতার চিত্র। আগুন নেভানোর আগেই আশপাশের মানুষ ছুটে গেছে উদ্ধারকাজে। কেউ পানি এনে দিয়েছে, কেউ দগ্ধ শিশুদের হাসপাতালে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে। অজস্র অচেনা মুখের এই মানবিক উদ্যোগই আমাদের জাতিসত্তার অন্যতম গৌরব।

বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ চিরকালই দুর্যোগে এগিয়ে এসেছে। যখনই হানা দিয়েছে দুর্যোগ দুর্বিপাক তখনই আমরা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অসাধারণ সংবেদনশীলতা। সত্তরের গোর্কির মানবিক বিপর্যয়ের দিনগুলোতে কাঁদো বাঙালি কাঁদো- ব্যানার সামনে নিয়ে মিছিল করে ত্রাণের জন্য ভিক্ষা করতে দেখেছি আমরা সংবেদনশীল তরুণদের। ১৯৮৬ সালে জগন্নাথ হল ট্র্যাজেডির খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো তরুণ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল উদ্ধারকাজে। রানা প্লাজা ধস, কিংবা করোনা মহামারির সময়- যেখানেই মানবিক বিপর্যয়, সেখানেই অগণিত মানুষ নিজেদের স্বার্থ ভুলে বিপদগ্রস্তের পাশে দাঁড়িয়েছে। উত্তরা দুর্ঘটনার পরও আমরা দেখেছি, কত মানুষ রক্ত দিতে ছুটে গেছে বার্ন ইনস্টিটিউটে, খাবার-জরুরি ওষুধ নিয়ে পৌঁছেছে স্বেচ্ছায়। এমনকি হাসপাতালে বসে অচেনা দগ্ধ শিশুর হাত ধরে চোখের পানি ফেলেছে অনেকেই। পরিতাপের বিষয়, এ দেশের রাজনীতি বাঙালির, বিশেষ করে তরুণদের এই মানবিকবোধ ও সংবেদনশীলতার পরিচর্যা করেনি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমাদের রাজনীতি বিভেদ ও হিংসাকে উসকে দিয়েছে।

মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির পটভূমিতে মানবিকতার পাশাপাশি ভেসে এসেছে কিছু দুঃখজনক ও দৃষ্টিকটু চিত্র। দুর্ঘটনার পরপরই একদল রাজনৈতিক নেতানেত্রী ও তাদের অনুসারীরা দলে দলে হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন। সংবেদনশীল পোড়া রোগীদের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে অনাবশ্যক বক্তৃতা দিয়েছেন, প্রেস-ফটোগ্রাফার নিয়ে এসে ‘দুঃখপ্রকাশ’-এর নামে ফটোসেশন করেছেন, কেউ কেউ আবার ঘটনার জন্য সরকার বা কোনো পক্ষকে দায়ী করে রাজনৈতিক বিবৃতি দিয়েছেন। এতে হাসপাতালের সুশৃঙ্খল পরিবেশ বিঘ্নিত হয়েছে, দগ্ধ রোগীদের পরিবার হয়ে পড়েছে আরও উদ্বিগ্ন।

মানবিক বিপর্যয় কখনোই রাজনৈতিক ফায়দা তোলার উপযুক্ত ক্ষেত্র নয়। দুর্যোগে দায়িত্বশীল আচরণ মানে কেবল সহানুভূতির ছবি পোস্ট করা নয়, বরং বাস্তব সহায়তা নিশ্চিত করা। এই সময় সবচেয়ে প্রয়োজন রক্ত, চিকিৎসা, প্রার্থনা এবং নীরবে পাশে থাকা। অথচ কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠীর আচরণে তা নিছক মিডিয়া শোয়ে পরিণিত হয়েছে, যা একদিকে যেমন দৃষ্টিকটু, অন্যদিকে তেমনি আহত মানুষদের প্রতি অসম্মানজনক।

প্রসঙ্গত, আমাদের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কথাও এ ঘটনার প্রেক্ষাপটে নতুন করে ভাবতে হবে। এমন জনবহুল এলাকায় কীভাবে বিমান চলাচল হচ্ছে, স্কুলের পাশে এমন ঝুঁকিপূর্ণ বিমানপথ কীভাবে অনুমোদিত হয়েছে, দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে ফায়ার সার্ভিস ও বার্ন ইউনিটের সামর্থ্য কতটুকু- এসব প্রশ্নের উত্তর দরকার। আমরা দুর্ঘটনা ঘটার পর হাহাকার করি, কিন্তু প্রতিরোধে উদ্যোগ নেই। এই শৈথিল্য আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক ভয়ংকর ইঙ্গিত বহন করে।

তবে এর মধ্যেও আলোর রেখা আছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যেমন আবেগপ্রবণ পোস্ট দেখেছি, তেমনি দায়িত্বশীল উদ্যোগও দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা রক্তদানে সংগঠিত হয়েছে, স্থানীয় ক্লাবগুলো আর্থিক সহায়তা দিতে তহবিল গঠন করেছে, সাধারণ মানুষ নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী সহায়তা করতে ছুটে গেছে বার্ন ইউনিটে। এই স্বতঃস্ফূর্ত মানবিক সাড়া প্রমাণ করে, মানুষের ভেতর এখনও করুণার আলো জ্বলে।

এই ঘটনার আলোকে আমাদের করণীয় কী?
প্রথমত জরুরি ভিত্তিতে দুর্ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্ত ও দায় নির্ধারণ করতে হবে। ভবিষ্যতে যাতে এর পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। দ্বিতীয়ত সব স্কুল ও জনসমাগম এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ অবকাঠামো চিহ্নিত করে যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত পোড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য বার্ন ইউনিটে বিশেষ বরাদ্দ, চিকিৎসক প্রশিক্ষণ এবং আধুনিক সরঞ্জাম সরবরাহ জরুরি। চতুর্থত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের মৌন নীতিগত ঐক্য গড়ে উঠতে হবে- দুর্যোগ বা শোকের সময়ে কোনো রকম প্রচারমূলক কর্মকাণ্ড চালানো যাবে না। দলমত নির্বিশেষে এই সিদ্ধান্ত হলে জনগণের প্রতি সম্মান দেখানো হয় এবং বিপদগ্রস্ত মানুষের পাশে আমরা সত্যিকারের সংবেদনশীলতা নিয়ে দাঁড়াতে পারি।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো- আমাদের শিশুদের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করা। তারা যেন আর কখনো স্কুলে যাওয়ার পথে আগুনে ঝলসে না যায়, আর কোনো বাবা-মা যেন সন্তান হারিয়ে ‘আমার বাবুটা কোথায়?’ বলে ছুটে না বেড়ান- এই ন্যূনতম মানবিক শপথ নিতে হবে আমাদের।

উত্তরার মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে- আমরা কতটা ঝুঁকির মধ্যে আছি এবং মানবিকতার কী অপার সম্ভাবনা লুকিয়ে আছে আমাদের জনগণের মধ্যে। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করতে হবে। ফেসবুক স্ট্যাটাস নয়, বাস্তব পদক্ষেপে তা প্রমাণ করতে হবে। যেন আগামীকাল আবারও এমন কোনো সকাল না আসে, যেখানে বাতাসে পোড়া মাংসের গন্ধ মিশে যায় শিশুর আর্তনাদে।

এই বিভাগের আরও খবর

dainikamarbangla

হাইলাইটস

বিশেষ সংবাদ