এফ-৭ বিজিআই (F-7 BGI) একটি মাল্টি-রোল বা বহুমুখী যুদ্ধবিমান, যা একাধিক সামরিক অভিযানে পারদর্শী। এটি চীনের চেংডু এয়ারক্র্যাফ্ট করপোরেশন নির্মিত, এবং বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর (বিএএফ) নির্দিষ্ট প্রয়োজনের আলোকে এর ডিজাইন করা হয়েছে যাতে এটি কার্যকর কিন্তু ব্যয়-সাশ্রয়ী সমাধান হতে পারে।
চেংডুর তৈরি এফ-সিরিজের বিমানের মধ্যে F-7 BGI কে সর্বাধুনিক ও উন্নত সংস্করণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এটি মূলত চীনের জে-৭ জি (J-7G) যুদ্ধবিমানের প্রযুক্তি ব্যবহার করে উন্নতভাবে নির্মিত, যেখানে ‘BGI’-এর ‘I’ বোঝায় “Improved” বা আধুনিকায়িত।
প্রযুক্তিগত বিবরণ ও সক্ষমতা
-
ইঞ্জিন: F-7 BGI এক ইঞ্জিন বিশিষ্ট যুদ্ধবিমান। এতে রয়েছে WP-13F আফটারবার্নিং টার্বোজেট ইঞ্জিন, যা বিমানটিকে উচ্চ গতি ও উচ্চতায় উড়তে সক্ষম করে।
-
সর্বোচ্চ গতি: এটি সর্বোচ্চ Mach 2.2 গতিতে উড়তে পারে, যা ঘণ্টায় প্রায় ২,৪৭০ কিলোমিটার।
-
পরিসর (Range): এটির ফেরি রেঞ্জ বা জ্বালানি ভরতি করে একটানা উড়ে ফিরে আসার সক্ষমতা প্রায় ২,০০০ কিলোমিটার।
-
ককপিট ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা: বিমানটির ককপিট আধুনিক ‘গ্লাস ককপিট’ যেখানে মাল্টি-ফাংশন ডিসপ্লে (MFD) এবং হ্যান্ডস অন থ্রটল অ্যান্ড স্টিক (HOTAS) ব্যবস্থা রয়েছে, যা পাইলটকে উন্নত নিয়ন্ত্রণ ও সজাগ প্রতিক্রিয়া প্রদানে সাহায্য করে।
-
রাডার: এতে ব্যবহৃত হয়েছে KLJ-6F পালস-ডপলার রাডার, যার কার্যকর রেঞ্জ ৮০ কিলোমিটারের বেশি। এটি একাধিক লক্ষ্যবস্তু শনাক্ত করতে সক্ষম।
-
অস্ত্র বহন ক্ষমতা:
এফ-৭ বিজিআই নানাবিধ অস্ত্র বহন করতে সক্ষম, যার মধ্যে রয়েছে:-
PL-5 ও PL-9 ইনফ্রারেড গাইডেড স্বল্প পাল্লার এয়ার-টু-এয়ার মিসাইল
-
৩০ মিমি কামান
-
ফ্রি-ফল বোমা ও রকেট পড
-
লেজার গাইডেড বোমা (যেমন Mk 81, Mk 82 - TEBER গাইডেন্স কিটসহ)
-
GPS-নির্ভর বোমা
-
সর্বোচ্চ ৩০,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত সাসপেন্ডেড আর্মামেন্ট
-
-
মিশনের ধরন: বিমানটি শুধুমাত্র আকাশ-আকাশ (Air-to-Air) নয়, স্থলভিত্তিক লক্ষ্যবস্তুতেও আঘাত হানতে সক্ষম, যেমন লেজার গাইডেড বোমা বা রকেট ব্যবহার করে Air-to-Ground মিশন পরিচালনা।
সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ
তবে উন্নত বৈশিষ্ট্যের পাশাপাশি F-7 BGI-এর কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, যা একে আধুনিক ৪র্থ বা ৪.৫ প্রজন্মের যুদ্ধবিমান থেকে কিছুটা পিছিয়ে রাখে:
-
দূর পাল্লার মিসাইল (BVR) সীমাবদ্ধতা: বিমানটি দৃষ্টিসীমার বাইরে (Beyond Visual Range) আক্রমণের জন্য সক্ষম নয়, কারণ এটি শুধুমাত্র স্বল্প-পাল্লার ইনফ্রারেড গাইডেড মিসাইল (PL-5, PL-7 বা সম্ভাব্যভাবে PL-9) বহন করতে পারে। ফলে প্রতিপক্ষকে দূর থেকে ধ্বংস করার সুযোগ কম।
-
ডিজাইনের দিক থেকে পুরনো: এফ-৭ বিজিআই মূলত মিগ-২১ যুদ্ধবিমানের ১৯৫০–৬০ দশকের পুরনো নকশার ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যদিও আধুনিকায়িত ডাবল ডেল্টা উইং যুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এর এরোডাইনামিক পারফরম্যান্স আধুনিক ৪র্থ প্রজন্মের বিমানের তুলনায় পিছিয়ে।
-
অস্ত্র বহন ক্ষমতা সীমিত: এটি সর্বোচ্চ ৩,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত বোমা বা রকেট বহন করতে পারে, যেখানে JF-17 Thunder বা Dassault Rafale মতো আধুনিক বিমানগুলো ৬,০০০–৯,০০০ পাউন্ড পর্যন্ত বহনে সক্ষম।
-
রাডার ও সেন্সর সীমাবদ্ধতা: KLJ-6F রাডার কার্যকর হলেও এটি AESA রাডার বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন আধুনিক সেন্সর সিস্টেমের তুলনায় পিছিয়ে।
-
ইলেকট্রনিক যুদ্ধ সক্ষমতা দুর্বল: বিমানটি ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার (EW), জ্যামিং, বা সিগন্যাল ইন্টেলিজেন্স সংগ্রহের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে দুর্বল।
-
এক ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরতা: F-7 BGI একমাত্র ইঞ্জিনের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় যান্ত্রিক ত্রুটি ঘটলে বিকল্প ইঞ্জিনের অভাবে পাইলটের জীবনের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে এফ-৭ বিজিআই-এর অন্তর্ভুক্তি
বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রথম ১৯৮০’র দশকে চীনের F-7MB যুদ্ধবিমান ব্যবহার শুরু করে। পরে ২০০৬–২০০৮ সালে আরও উন্নত সংস্করণ F-7BG যুক্ত করা হয়। এরপর সময়ের চাহিদা অনুযায়ী আধুনিক মাল্টি-রোল যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন দেখা দিলে বাংলাদেশ F-7 BGI সংগ্রহের সিদ্ধান্ত নেয়।
২০১১ সালে চেংডু এয়ারক্র্যাফ্ট ইন্ডাস্ট্রি গ্রুপের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিমানগুলো সরবরাহ শুরু হয় এবং ২০১৩ সালের মধ্যেই সবগুলো বিমান বাংলাদেশে এসে পৌঁছায়।
সম্প্রতি এই বিমানের একটি বিমান দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে, যা বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ডেকে এনেছে।