২০২৪ সালের ১৪ জুলাই কোটা আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ক্যাম্পাস 'রাজাকার' স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরাও এই আন্দোলনে যোগ দেয়।
ওই রাতে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ঢাবির তৎকালীন উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামালের মধ্যে একটি ফোনালাপ হয়। এই কথোপকথনটি চানখাঁরপুলে ৫ আগস্ট সংঘটিত ছয়জন হত্যার মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সূচনা বক্তব্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করেন চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।
ওই ফোনালাপে শেখ হাসিনা আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ করে বলেন, “কোন দেশে বাস করি আমরা। এদের বাড়তে বাড়তে তো...রাজাকারদের কী অবস্থা হয়েছে দেখিস নাই, সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও (আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা) ছাড়বো না।”
১৪ জুলাই রাত ১১টা ২৮ মিনিটে উপাচার্য মাকসুদ কামাল শেখ হাসিনাকে ফোন করেন। তিনি নিজের বাসার সামনে আন্দোলনের পরিস্থিতির কথা জানান এবং যেকোনো মুহূর্তে তাঁর বাসায় হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি শেখ হাসিনাকে বলেন, আন্দোলনকারীরা “তারা রাজাকার হতে চায়” বলে স্লোগান দিচ্ছে।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এই কথোপকথনের লিখিত রূপ তুলে ধরেন। তিনি বলেন, সেদিন মাকসুদ কামাল শেখ হাসিনাকে বলেছিলেন, “প্রত্যেক হল থেকে তো ছেলেমেয়েরা তালা ভেঙে বের হয়ে গেছে। এখন তারা রাজু ভাস্কর্যে, চার–পাঁচ হাজার ছেলে-মেয়ে জমা হয়েছে। মল চত্বরে জমা হয়েছে এবং যেকোনো মুহূর্তে আমার বাসাও অ্যাটাক (আক্রমণ) করতে পারে।”
এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “তোমার বাসা প্রটেকশনের (সুরক্ষার) কথা বলে দিছি।”
মাকসুদ কামাল তখন জানান, “ওই রকম একটা প্রস্তুতি...লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হইছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “লাঠিসোঁটা নিয়ে বের হলে হবে না, আমি পুলিশ এবং বিডিআর হয়ে বিজিবি আর...বলছি খুব অ্যালার্ট (সতর্ক) থাকতে এবং তারা রাজাকার হইতে চাইছে তো, তাদের সবাই রাজাকার। কী আশ্চর্য কোন দেশে বসবাস করি।”
মাকসুদ কামাল জবাবে বলেন, “জি জিৃ বলতেছে আমরা সবাই রাজাকার।”
তখন শেখ হাসিনা বলেন, “তো রাজাকারের তো ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও তাই করব। একটাও ছাড়ব না, আমি বলে দিছি। এই এত দিন ধরে আমরা কিন্তু বলিনি, ধৈর্য ধরছি, তারা আবার বাড়ছে।”
মাকসুদ কামাল তখন বলেন, “বেশি বেড়ে গেছে এবং অতিরিক্ত বেড়ে গেছে, অতিরিক্ত...। আপা একটু ক্যাম্পাসের নিরাপত্তাটা আরেকটু বাড়ানো...। আর আমার বাসার ওইখানেও...।”
শেখ হাসিনা তখন বলেন, “ক্যাম্পাসের...ব্যবস্থা করছি, সমস্ত ক্যাম্পাসে বিজিবি, র্যাব এবং পুলিশ—সব রকম ব্যবস্থা হচ্ছে। তোমার বাসার ভেতরে লোক রাখতে বলছি। ভেতরে কিছু রাখা আছে...এত বাড়াবাড়ি ভালো না।”
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কারের হুমকি
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম কথোপকথনের আরও কিছু অংশ পড়ে শোনান। মাকসুদ কামাল শেখ হাসিনাকে বলেন, “বিজয় একাত্তর হলে ছাত্রলীগের ছেলেদেরকে মেরেছে। আরও দু–একটা হলে একই কাজ করেছে। ছাত্রলীগের ছেলেপেলে সাদ্দাম (এখন নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সভাপতি), ইনান (নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক), শয়ন (নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সভাপতি) ওরা আমার বাসায় ছিল সন্ধ্যা থেকে। আমি খবর পাচ্ছিলাম, ওদেরকে আমি ডেকে নিয়ে আসছি, ওরাও আসছে। ওদের সাথে বসে ওদের হলে হলে যেন ছাত্রলীগকে সংঘবদ্ধ রাখে এবং ঢাকা উত্তর, দক্ষিণকে যেন খবর দেয়। এগুলা করতে করতেই হাজার হাজার ছেলেমেয়ে একত্র হয়ে গেছে।”
এর জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “কোন দেশে বাস করি আমরা। এদেরকে বাড়তে বাড়তে তো...রাজাকারদের কী অবস্থা হয়েছে দেখিস নাই, সবগুলাকে ফাঁসি দিছি, এবার তোদেরও ছাড়ব না।”
তখন মাকসুদ কামাল বলেন, “হ্যাঁ, এবার এই ঝামেলাটা যাক, এরপরে আমিও নিজে ধরে ধরে যারা এই অস্থিরতা সৃষ্টি করছে, মেইন যারা আছে, এদের বহিষ্কার করব ইউনিভার্সিটি থেকে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “সব এইগুলাকে বাইর করে দিতে হবে...আমি বলে দিচ্ছি আজকে সহ্য করার পরে অ্যারেস্ট (গ্রেপ্তার) করবে, ধরে নেবে এবং যা অ্যাকশন নেওয়ার নেবে...কারণ ইংল্যান্ডে এ রকম ছাত্ররাজনীতির জন্য মাঠে নামল, কতগুলি মেরে ফেলায় দিল না?”
জবাবে মাকসুদ কামাল বলেন, “জি জি জি।”
শেখ হাসিনা বলেন, “ওই অ্যাকশন না নেওয়া ছাড়া উপায় নাই। আমরা এত বেশি সহনশীলতা দেখাই আজ এত দূর পর্যন্ত আসছে।”
মাকসুদ কামাল বলেন, “এটা তো...আমরাও তো সহনশীলতা...আমি ছাত্রলীগকে বলছি যে তোমরা কোনো ধরনের ইয়ে করতে যাইও না। যেহেতু আদালতের বিষয়, আদালত নিষ্পত্তি করবে।”
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “না, এ আদালত হবে না, আবার ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিছে।”
তখন মাকসুদ কামাল বলেন, “আবার রাষ্ট্রপতিকে কেউ এই রকম বলে যে ২৪ ঘণ্টার রাষ্ট্রপতিকে কেউ আলটিমেটাম দেয় একটা দেশে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “রাষ্ট্রপতিকে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিচ্ছে...বেয়াদবির একটা সীমা থাকে!”
মাকসুদ কামাল তখন বলেন, “আপা, আমি আপনাকে যদি অন্য কোনো খারাপের দিকে যায়, আমি আবার একটু জানাব। কিন্তু রাতের বেলা জানাব না, হয়তোবা আধা ঘণ্টা এক ঘণ্টার মধ্যে হলে জানাব।”
শেখ হাসিনা বলেন, “কোনো অসুবিধা নাই...আমি আমি সব সময়ই ফ্রি।”
মাকসুদ কামাল বলেন, “জি জি জি, স্লামুআলাইকুম।”
“আপনাদের স্বাধীনতা দিয়েছি যেখানে যেমন সিচুয়েশন সেভাবে”
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম ওই ফোনালাপের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমানের একটি বেতার বার্তাও ট্রাইব্যুনালে পড়ে শোনান। গত বছরের ১৮ জুলাই দেওয়া ওই বার্তায় হাবিবুর রহমান বলেন, “আমাদের সকল অফিসার যে যেখানে আছেন ডিউটি করছেন আমাদের নিজের জীবন–সম্পদ রক্ষা, অফিস–আদালত রক্ষা, জনগণের জীবন–সম্পদ রক্ষা করার জন্য আপনার সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন। আমি বারবার...বলেছি, নির্দেশ দিয়েছি, আপনাদের স্বাধীনতা দিয়েছি যেখানে যেমন সিচুয়েশন (পরিস্থিতি) সেভাবে...আপনারা করবেন আপনারা কিলিং পজিশনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে, হাঁটু গেড়ে কোমরের নিচে আপনারা গুলি করে দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনবেন, ওভার।”
“সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে গুলি ও হত্যার নির্দেশ”
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম তাঁর বক্তব্যে বলেন, ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার হাবিবুর রহমানের নির্দেশে গত বছরের ৫ আগস্ট চানখাঁরপুলে ৪০-৪৫ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হয়েছিল। ডিএমপির তৎকালীন যুগ্ম পুলিশ কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার শাহ্ আলম মো. আখতারুল ইসলাম এবং সহকারী পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ ইমরুল ও শাহবাগ থানার পুলিশ পরিদর্শক মো. আরশাদ হোসেন “সুনির্দিষ্টভাবে টার্গেট করে গুলি চালানোর নির্দেশ” দেন।
চিফ প্রসিকিউটরের ভাষ্যমতে, এই নির্দেশ অনুযায়ী তৎকালীন কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাজ হোসেন ও নাসিরুল ইসলামের গুলিতে চানখাঁরপুল ও তার আশেপাশের এলাকায় ছয়জনকে হত্যা করা হয়। এই নির্দেশনার অডিও ক্লিপ উদ্ধার করা হয়েছে। কনস্টেবল শেখ শফিক মোহাম্মদ ১৮ জুলাই ডিএমপি কন্ট্রোল রুমে একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে এই নির্দেশনার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আরও বলেন যে, গত বছরের ১৮ জুলাই ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ফজলে নূর তাপসের সঙ্গে শেখ হাসিনার আরেকটি টেলিফোন কথোপকথনে জানা যায় যে, তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে হেলিকপ্টার, ড্রোন এবং 'লেথাল উইপন' (মারণাস্ত্র) ব্যবহার করে নির্বিচার গুলির আদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন, এই মামলাটি প্রত্যক্ষ প্রমাণের ওপর ভিত্তি করে গঠিত হয়েছে, যা এই বিচার শুরু করার একটি নির্ভরযোগ্য ভিত্তি।