আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের জনক আলবার্ট আইনস্টাইন—একটি নাম, যিনি শুধু একবিংশ শতাব্দীর নয়, সমগ্র মানবসভ্যতার বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে আছেন। আপেক্ষিকতার তত্ত্ব, E=mc² সূত্র কিংবা ফটোইলেকট্রিক ইফেক্ট—এই সবই তার মস্তিষ্কপ্রসূত। কিন্তু অবাক করার মতো হলেও সত্য, এই জিনিয়াস বিজ্ঞানী তার কর্মজীবনে একাধিকবার ভুল করেছেন—কখনো ধারণাগত, কখনো দার্শনিক, আবার কখনো তথ্য-প্রমাণ উপেক্ষার মাধ্যমে এবং এসব ভুল শুধু ব্যক্তিগত নয়, বিজ্ঞানের ইতিহাসেও রেখেছে তাৎপর্যপূর্ণ ছাপ।
১. স্থির মহাবিশ্বের ভুল ধারণা ও কসমিক কনস্ট্যান্ট
১৯১৭ সালে আইনস্টাইন সাধারণ আপেক্ষিকতার সমীকরণে একটি নতুন প্যারামিটার যোগ করেন—Cosmological Constant (Λ)। উদ্দেশ্য ছিল, মহাবিশ্বকে "স্থির" রাখতে, কারণ সে সময়কার বিজ্ঞান মহাবিশ্বকে চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয় ধরে নিয়েছিল। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল পর্যবেক্ষণমূলকভাবে প্রমাণ করেন, মহাবিশ্ব আসলে প্রসারিত হচ্ছে। সেই আবিষ্কারে আইনস্টাইন নিজেই স্বীকার করেন:
"Adding the cosmological constant was the biggest blunder of my life."
তবে আধুনিক কসমোলজিতে (ডার্ক এনার্জি বোঝাতে) এই Λ পুনরায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। তবুও, তাত্ত্বিকভাবে এটি সংযোজনের পেছনে ভুল দার্শনিক চিন্তা ছিল।
রেফারেন্স: Isaacson, Einstein: His Life and Universe (2007)
২. কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভিত্তি প্রত্যাখ্যান
যেখানে আইনস্টাইন ফটোইলেকট্রিক ইফেক্টের মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিকসের সূচনায় অবদান রেখেছেন, সেখানেই তিনি এই তত্ত্বের মূল দর্শন—অনিশ্চয়তা ও সম্ভাবনাবাদের বিরোধিতা করেন। তিনি বলেন,
“God does not play dice with the universe.”
তাঁর বিশ্বাস ছিল, প্রকৃতি অনির্ধারিত হতে পারে না। এ কারণে তিনি ১৯৩৫ সালে পডলস্কি ও রোজেনকে নিয়ে গঠিত EPR প্যারাডক্স উপস্থাপন করেন। যদিও এটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে, পরে বেল থিওরেম এবং আধুনিক পরীক্ষাগুলো দেখিয়ে দেয় আইনস্টাইন ভুল ছিলেন।
রেফারেন্স: Einstein, Podolsky & Rosen, Phys. Rev. (1935)
৩. ব্ল্যাক হোল নিয়ে সংশয়
আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা থেকেই ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের গণিতগত ভিত্তি আসে। কিন্তু ১৯৩৯ সালে তিনি নিজেই দাবি করেন, প্রকৃতিতে ব্ল্যাক হোল গঠিত হতে পারে না। তিনি এবং রোজেন মিলে এমনই একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন যেখানে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বকে 'অবাস্তব' বলা হয়।
আজ, ব্ল্যাক হোল শুধু তাত্ত্বিক নয়—পর্যবেক্ষণেও ধরা পড়ে। ২০১৯ সালে বিশ্বের প্রথম ব্ল্যাক হোলের ছবি প্রকাশ পেয়েছে।
রেফারেন্স: Einstein & Rosen, Phys. Rev. (1939)
৪. একীভূত ক্ষেত্র তত্ত্বে (Unified Field Theory) ব্যর্থতা
জীবনের শেষ তিন দশক আইনস্টাইন ব্যয় করেন এমন একটি তত্ত্ব তৈরির পেছনে, যা ইলেকট্রোম্যাগনেটিজম ও মহাকর্ষকে একই কাঠামোয় ব্যাখ্যা করবে। তিনি কোয়ান্টাম তত্ত্ব, পারমাণবিক বল কিংবা নতুন কণার আবিষ্কার এড়িয়ে চলেন। ফলে তাঁর এই প্রয়াস বিজ্ঞানের মূলধারার বাইরে চলে যায় এবং ফলপ্রসূ হয়নি।
তবুও, আধুনিক স্ট্রিং থিওরি বা কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির মতো তত্ত্বগুলো এই উদ্দেশ্যেই আবার জন্ম নিয়েছে।
রেফারেন্স: Abraham Pais, Subtle is the Lord (1982)
৫. নীতিগত দ্বিধা ও মানবিক ভুল
আইনস্টাইন শুরুতে শান্তিবাদী অবস্থানে থাকলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি প্রকাশ্যে যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নেননি। পরে অবশ্য হিটলারবিরোধী অবস্থানে ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসিবাদের বিরোধিতায় সক্রিয় হন। সবচেয়ে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ছিল—১৯৩৯ সালে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে লেখা চিঠিতে পারমাণবিক বোমা তৈরি বিষয়ে বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ, যা ম্যানহ্যাটান প্রকল্প সূচিত করে।
পরে তিনি নিজেই বলেন,
“Had I known that the Germans would not succeed in developing an atomic bomb, I would have done nothing.”
রেফারেন্স: Fölsing, Albert Einstein: A Biography (1997)
আলবার্ট আইনস্টাইনের ভুলগুলো আমাদের মনে করিয়ে দেয়—বিজ্ঞানী মানেই নিখুঁত নয়, বিজ্ঞানীরাও ভুল করতে পারেন; ভুল ধারণা প্রকাশ করতে পারেন। বিজ্ঞান এমন এক অভিযাত্রা, যেখানে প্রতিটি সাফল্যের পেছনে থাকে শত ব্যর্থতা, সংশয় আর ভুলের স্তর। আইনস্টাইন যেমন স্বপ্ন দেখেছিলেন একীভূত তত্ত্বের, তেমনি ভুলও করেছিলেন ব্ল্যাক হোল বা কোয়ান্টাম বাস্তবতা অস্বীকার করে। কিন্তু তার এই ভুলগুলো তাকে ছোট করেনি, বরং এটাই বলে যে, কোনো বিজ্ঞানীর কথা মানেই তা চিরন্তন সত্য হবে- এমন কোনো মানে নেই। তাই আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী নিজের ভুল স্বীকার করতে দ্বিধা করেননি, বরং তা থেকে শিক্ষা নিয়ে অন্যদের সামনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
আইনস্টাইনের ভুলগুলো এক নজরে
ক্রমিক নং | ভুল | ব্যাখ্যা | আজকের বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ |
১ | কসমিক কনস্ট্যান্ট (Λ) | মহাবিশ্বকে স্থির ধরে Λ যোগ | আজ ডার্ক এনার্জিতে Λ-এর গুরুত্ব অনস্বীকার্য |
২ | কোয়ান্টাম বাস্তবতা অস্বীকার | EPR প্যারাডক্স দিয়ে চ্যালেঞ্জ | অনিশ্চয়তা ও অ্যানট্যাঙ্গলমেন্ট প্রমাণিত |
৩ | ব্ল্যাক হোল অস্বীকার | গঠনের সম্ভাবনাকে নাকচ | পর্যবেক্ষণে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্ব |
৪ | Unified Field Theory | কেবল GR ও EM সংযুক্তি | আধুনিক ফিজিক্সে স্ট্রিং থিওরি এগিয়েছে |
৫ | পরমাণু বোমার সুপারিশ | রুজভেল্টকে চিঠি | নৈতিক দিক থেকে বিতর্কিত সিদ্ধান্ত |