logo
ads

শাহ্ মুহাম্মদ সগীর: প্রথম বাঙালি ‍মুসলিম কবি

যাপ্র সাহিত্য

প্রকাশকাল: ৩০ জুলাই ২০২৫, ১২:২২ এ.এম
শাহ্ মুহাম্মদ সগীর: প্রথম বাঙালি ‍মুসলিম কবি

ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ এক রকম দ্বৈতধর্মী বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ—একদিকে ধর্মীয় প্রভাব, অন্যদিকে প্রেম ও মানবিক সম্পর্কের বিমূর্ত অভিব্যক্তি। এই ধারার মধ্যে কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর ছিলেন এক ব্যতিক্রমী প্রতিভা, যিনি মুসলমান রোমান্স সাহিত্যকে কাব্যিক ঐতিহ্যে পরিণত করেছেন। তিনি ছিলেন ফারসি-আরবি প্রভাবিত চট্টগ্রাম অঞ্চলের একজন দরবেশপ্রতিম কবি, যাঁর কাব্য ইসলামি ভাবধারা ও প্রেমকাব্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটায়।

পরিচিতি ও সাহিত্যিক প্রেক্ষাপট

শাহ মুহাম্মদ সগীর সম্ভবত চতুর্দশ শতকের শেষভাগে বা পঞ্চদশ শতকের প্রথমভাগে বাংলা সাহিত্যে সক্রিয় ছিলেন। তিনি প্রথম বাঙালি ‍মুসলিম কবি যিনি বাংলার সুলতানি আমলের কবি ছিলেন। তাঁর কাব্যচর্চা মূলত তৎকালীন আরবি-ফারসি সাহিত্যচর্চার ছায়ায় হলেও তিনি তার মধ্যে নিটোল বাঙালি চেতনার বিকাশ ঘটিয়েছেন।

তিনি ছিলেন সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহ (১৩৮৯–১৪১০)–এর দরবারের কবি। তাঁর সাহিত্যিক অনুরাগ ছিল সুফিবাদ, প্রাচ্য প্রেমগাথা এবং ধর্মীয় ঐতিহ্যের সম্মিলনে। তিনি নিজের পরিচয় দিয়েছেন "আল-মুছান্নিফ শাহ মুহম্মদ সগীর" নামে।

ইউসুফ-জুলেখা: প্রেম, সাধনা ও ধর্মচেতনার সংমিশ্রণ

‘ইউসুফ-জুলেখা’ শাহ মুহাম্মদ সগীরের একমাত্র ও অমর কাব্যগ্রন্থ, যা বাংলা মুসলিম রোমান্স সাহিত্যের পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিত। এটি মূলত কুরআনের একটি কাহিনির কাব্যরূপ, তবে এতে কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, রয়েছে সুফি ভাববাদ, মানবিক প্রেম, আত্মত্যাগ ও চারিত্রিক দৃঢ়তার এক অনবদ্য প্রতিচ্ছবি।

বিশেষ বৈশিষ্ট্য:

  • ইউসুফ চরিত্রে ঈশ্বরপ্রদত্ত সৌন্দর্য ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রতীক।

  • জুলেখা চরিত্রে তীব্র প্রেম ও তার মাধ্যমে আত্মিক মুক্তির ইঙ্গিত।

  • সুফিবাদের নান্দনিক প্রতিফলন—প্রেম হলো আত্মার পরিশুদ্ধি।

  • আলঙ্কারিক ভাষা, গদ্য-কবিতার ধাঁচ, আরবি-ফারসি শব্দপ্রয়োগ।

শাহ মুহাম্মদ সগীর তাঁর রচনায় ইউসুফ-জুলেখার কাহিনিকে কেবল এক দুঃখগাঁথা প্রেমকাহিনি হিসেবে নয়, বরং ঈশ্বরচিন্তা ও আধ্যাত্মিক পথের রূপক হিসেবে তুলে ধরেছেন।

ভাষা ও শৈলী: আরবি-ফারসি প্রভাবের গঠনমূলক ব্যবহার

কবির কাব্যভাষা ছিল সমসাময়িক বাংলা হলেও এতে রয়েছে ফারসি শব্দের আবেশ, যা রচনাকে অলংকৃত করেছে। তিনি মূলত:

  • আরবি-ফারসি শব্দের মার্জিত প্রয়োগ করেছেন, যা কাব্যের গাম্ভীর্য বাড়ায়।

  • উপমা-অলঙ্কারে ইসলামি কাব্যধারার আভিজাত্য রক্ষা করেছেন।

  • গদ্য ও পদ্যের মাঝামাঝি এক ধাঁচে কাব্য রচনা করেছেন, যা পরবর্তী সাহিত্যে প্রভাব বিস্তার করে।

এভাবে শাহ মুহাম্মদ সগীর বাংলা ভাষার কাঠামোতে এক প্রাঞ্জল ইসলামি-সাংস্কৃতিক ভাষাবিন্যাস তৈরি করেন।

 ধর্ম ও মানবতাবোধের সমন্বয়

তাঁর কাব্যে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও তা নিছক প্রচারমূলক নয়; বরং একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির অংশ। তিনি ইউসুফের চরিত্রে একজন নিঃস্বার্থ প্রেমিক, নৈতিকতাবাদী ও আত্মস্থ মানুষকে উপস্থাপন করেছেন, যার ধর্ম কেবল নামাজ-রোজার নয়, বরং চারিত্রিক দৃঢ়তার মধ্য দিয়ে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন।

এই দৃষ্টিভঙ্গিই মধ্যযুগীয় ইসলামি কাব্যধারায় এক নতুন ব্যঞ্জনা এনে দেয়।

ঐতিহাসিক প্রভাব ও উত্তরাধিকার

শাহ মুহাম্মদ সগীর বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যধারার প্রথম সারির কবিদের একজন। তাঁর কাব্য কেবল সাহিত্য নয়, এক ঐতিহাসিক দলিলও বটে—যা মুসলমানদের ভাষাচর্চা, ধর্মীয় অনুভব এবং আধ্যাত্মিক ভাবনার পরিচয় দেয়।

‘ইউসুফ-জুলেখা’ বাংলা সাহিত্যজগতে ইসলামী রোমান্স সাহিত্যের প্রথম পূর্ণাঙ্গ প্রয়াস। পরে মওলানা দাউদ (চন্দ্রাবতী রামায়ণের সমসাময়িক), সৈয়দ আলাওল বা কবি দৌলত কাজী প্রমুখ এই ধারাকে এগিয়ে নিয়ে যান।

সাহিত্যে প্রেম ও ধর্মের এক সংলগ্ন জ্যোতিষ্ক

শাহ মুহাম্মদ সগীর বাংলা কাব্যধারার সেই পুরোধা কবি, যিনি মধ্যযুগীয় ধর্মীয় অনুপ্রেরণাকে সাহিত্যিক নান্দনিকতায় রূপ দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন না নিছক ধর্মপ্রচারক, আবার কেবল প্রেমিক কবিও নন—তিনি ছিলেন এমন একজন কবি, যিনি ধর্ম, প্রেম ও আত্মোপলব্ধির দৃষ্টিভঙ্গিকে এক সূত্রে গেঁথে বাংলা সাহিত্যে এক অনন্য কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেন।

তাঁর সাহিত্য আমাদের শুধু ঐতিহাসিক গৌরবের দিকে ফেরায় না, বরং নতুন করে ভাবতে শেখায়—ধর্ম ও সাহিত্য কিভাবে মানবিকতারই দু’টি রূপ।

dainikamarbangla

বিশেষ সংবাদ