বাংলা সাহিত্যের আলোচনায় কাজী নজরুল ইসলামের নাম উঠলে প্রথমেই উচ্চারিত হয় এক বিশেষ অভিধা—"বিদ্রোহী কবি"। তাঁর কালজয়ী কবিতা "বিদ্রোহী" তাঁকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাহিত্যিক উচ্চারণের এক প্রতীক বানিয়ে তুলেছে। কিন্তু নজরুল শুধু বিদ্রোহের কবি নন—তাঁর মধ্যে ছিল এক বহুমাত্রিক সত্তা, যা প্রেমিক, সংগীতজ্ঞ, আধ্যাত্মিক চিন্তক, রসিক সাহিত্যিক এবং অসাম্প্রদায়িক সমাজসংস্কারকের সম্মিলন। এই অজানা, অবহেলিত, বা কম আলোচিত দিকগুলো তুলে ধরা প্রয়োজন, যেন আমরা নতুন করে আবিষ্কার করতে পারি এক বহুরূপী নজরুলকে।
১. নারীচেতনা
নজরুলের সাহিত্যে নারী চেতনার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায়। তিনি তাঁর কবিতা ও গদ্যে নারীকে এক মর্যাদাসম্পন্ন, চিন্তাশীল, স্বাধীন ও সংগ্রামী মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করেন। "নারী"কবিতায় তাঁর উচ্চারণ:
"বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।"
এই বাক্য আজকের সামসময়িক ভাবনাতেও প্রাসঙ্গিক। এমনকি "মৃত্যুক্ষুধা" উপন্যাসের বসন্তি চরিত্রটি এক আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী, যে সমাজের চাপে ভেঙে পড়ে না। তিনি নারীকে কেবল ভালোবাসার বস্তু হিসেবে দেখেননি—নারীও সংগ্রামী, দেশপ্রেমিক, যোদ্ধা হতে পারে—এমন দৃষ্টিভঙ্গি নজরুলের লেখায় বিরল স্পষ্টতায় উঠে এসেছে।
২. আধ্যাত্মিক নজরুল: মরমিয়া চেতনার অনুসন্ধান
নজরুল ছিলেন সুদৃঢ় ধর্মীয় পরিচয়ের ধারক, কিন্তু ধর্মান্ধতার শত্রু। তাঁর বহু কবিতা ও গান ইসলামি ভাবধারায় প্রোথিত, কিন্তু তা কোনো সংকীর্ণতা বা ঘৃণার নয়—বরং এক মানবিক, মরমি দৃষ্টিভঙ্গির। তাঁর গজলে আছে হৃদয়ের আকুতি, আত্মার পিপাসা:
“যদি আর বাঁশি না বাজে, আমি যাব চুপে চুপে
নামাবো তোমার পায়ে আমার চোখের জলে।”
(গজল: যদি আর বাঁশি না বাজে)
তাঁর কবিতা “আমার কৈফিয়ত”–এ তিনি লেখেন:
“আমি হিন্দু, আমি মুসলমান,
এক পায়ে অমর্যাদায় গোঁজে কোরান-পুরাণ!”
তিনি ছিলেন ফকির লালনের মতই মরমিয়া ভাবধারার ধারক। নজরুলের "আল্লার নূর" ও "জিলজালাহ" কবিতায় এক মহাজাগতিক মানবতার অনুসন্ধান দেখা যায়।
৩. মুসলিম-হিন্দু মিলেমিশে থাকার ভাষ্যকার
নজরুল ছিলেন এমন এক সময়ের কবি, যখন উপমহাদেশে হিন্দু-মুসলমান বিভেদের বিষ ছড়াচ্ছিল রাজনীতির মারপ্যাঁচে। এই অবস্থায় নজরুল বলেছিলেন, “সাঁঝের বাতি হিন্দুর ঘরে, সকালবেলা মুসলমানের নামাজের আলো হয়ে ওঠে—আমি সেই আলো। আমি ধূপ-ধুনো আর আজানের কণ্ঠস্বর একত্র করতে চাই।”
তাঁর কবিতায় যেমন উঠে এসেছে শ্রীকৃষ্ণ, কালী, রাধা, তেমনি উঠে এসেছে কারবালার বীর, নবী, আল্লাহর প্রেম। তাঁর "কোরবানী", "মাদ-ই-নবী", "শিউলি", "মহরম"—সব মিলিয়ে তিনি ছিলেন ধর্মের উপাদানকে মানবতার খাতিরে একত্রীকরণের কারিগর।
৪. রসিক নজরুল: ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ও হাস্যরসের শিল্পী
নজরুলের সাহিত্য শুধু দ্রোহ আর প্রেমে পূর্ণ নয়, তাঁর ব্যঙ্গ-রচনাও সমকালীন সমাজের মুখোশ উন্মোচনের হাতিয়ার ছিল। "রাজবন্দীর জবানবন্দী", "চিকিৎসা সমস্যার সমাধান", "হেনার ভেল্কি", এমনকি তাঁর কিছু ছড়া ও গানেও রয়েছে দুর্দান্ত ব্যঙ্গরস।
“খাও খাও খোকা—ডিমভাজি খাও,
পোলাও খাও খোকা, কাবাবি খাও!”
(শিশুতোষ ব্যঙ্গরস)
এইসব রচনায় নজরুল সমাজের ভণ্ডামি, শিক্ষাব্যবস্থার ব্যর্থতা, রাজনীতির মেকি মুখোশ—সব কিছু নিপুণ রসিকতায় চিত্রিত করেছেন।
৫. নজরুলের সংগীতবিপ্লব: বহুধারার এক আশ্চর্য সেতুবন্ধ
নজরুল বাংলা সংগীতের ক্ষেত্রেও এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। তিনি বাংলা গানে সংযুক্ত করেছিলেন উর্দু, ফারসি, হিন্দি, আরবি, তুর্কি, ও পাশ্চাত্য সুরের অনুষঙ্গ। "নজরুলগীতি"—এই শব্দটি এখন বাংলা সংগীতের এক স্বতন্ত্র ধারা।
নজরুল সৃষ্ট প্রায় ৪,০০০ গানের মধ্যে অনেকগুলোই গজল, ঠুমরি, রাগাশ্রিত গান, কীর্তন ও ভক্তিমূলক সংগীত। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় ইসলামি গজলের প্রচলন করেন, এবং বাংলা হিন্দু ভজনের কাব্যিক সৌন্দর্যও নতুনভাবে রূপ দেন।
তিনি লিখেছিলেন:
“আমি সেই গান গাই
যে গানে জাগে প্রাণ, ওঠে প্রাণের কাঁপন
রাগে ও রসে ভরা, মরমের মাধুরী ধ্বনি।”
৬. নাটক ও উপন্যাসে নজরুল: কম আলোচিত অথচ শক্তিশালী
নজরুল নাট্যকার হিসেবেও ছিলেন শক্তিশালী, যদিও তাঁর এই দিকটি তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত। "আলেখ্য", "ঝিলিমিলি", "পুতুলের গান", "মরণরহস্য" নাটকগুলিতে তিনি সমাজ, ধর্ম, শ্রেণি ও নারী নিয়ে গভীর বার্তা রেখেছেন।
তাঁর একমাত্র পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস “মৃত্যুক্ষুধা” নিছক দারিদ্র্য নয়, এক সভ্যতার সংকট ও মানুষের অস্তিত্ব সংকটের প্রতিচ্ছবি। বসন্তি ও শিবনাথের দ্বন্দ্ব, প্রেম ও সংগ্রাম—আজও প্রাসঙ্গিক।
নজরুলকে শুধু "বিদ্রোহী কবি" তকমায় সীমাবদ্ধ রাখা ভুল হবে। তিনি প্রেমিক, দার্শনিক, সংগীতস্রষ্টা, রসিক, মানবতাবাদী ও আধ্যাত্মিক দার্শনিক। তাঁর প্রতিটি কবিতা, গান, প্রবন্ধ—নতুনভাবে পড়লে, দেখা যায় এক পরিপূর্ণ মানুষ, যিনি জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা—সব কিছুর ঊর্ধ্বে মানবতাকেই বড় করে দেখেছেন।
আজকের দগ্ধ পৃথিবীতে, যেখানে বিভাজনই রাজনৈতিক হাতিয়ার, সেখানে নজরুলের অজানা সাহিত্যিক দিকগুলো নতুনভাবে আলোচনার দাবি রাখে।
আমরা যদি তাঁকে সম্পূর্ণভাবে বুঝতে চাই, তাহলে দরকার—বিদ্রোহীর বাইরে নজরুলের হৃদয়ের মানুষটিকে চেনা।