"বিচার ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া যদি কেবল নির্বাচন আয়োজন করা হয়, তাহলে বাংলাদেশ আবারও আগের সংকটময় অবস্থায় ফিরে যাবে,"—সম্প্রতি সিঙ্গাপুরভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সিএনএ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক লোকি সু। সেখানে ড. ইউনূস বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা, অতীতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ে সরাসরি ও স্পষ্ট অবস্থান তুলে ধরেন।
তিনি বলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের যাত্রা শুরুর সময় চারটি মূল লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্তম্ভ হচ্ছে—সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন।" তার মতে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য কেবল নির্বাচন আয়োজন যথেষ্ট নয়।
"যদি সংস্কার ও বিচার কার্যক্রম ছাড়া নির্বাচন হয়, তাহলে দেশ আবারও পুরোনো রাজনৈতিক সংকটে পড়ে যাবে,"—মন্তব্য করেন তিনি।
তিনি অতীতের শাসনব্যবস্থাকে দুর্নীতিগ্রস্ত ও জালিয়াতিপূর্ণ আখ্যা দিয়ে বলেন, "আমরা যে রাজনৈতিক, প্রশাসনিক এবং নির্বাচনী ব্যবস্থা পেয়েছি, তা ছিল জালিয়াতিপূর্ণ। সবকিছুর অপব্যবহার হয়েছিল, যার ফলে দেশে ফ্যাসিবাদী সরকার প্রতিষ্ঠা পায়। সেই সরকার জনগণকে শোষণ করেছে, দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করেছে এবং সামাজিক কাঠামোকে ভেঙে দিয়েছে।"
অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সময়কার পরিস্থিতি তুলে ধরে তিনি বলেন, "দেশের অবস্থা দেখে মনে হয়েছিল, যেন রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্পের পর সবকিছু ধ্বংস হয়ে গেছে।" সেই ধ্বংসাবশেষের মধ্য থেকেই সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে বলে জানান তিনি। তবে এই কাজকে তিনি একবারেই শেষ হওয়ার মতো কিছু নয় বলে মনে করেন। "এই কাজ কখনোই পুরোপুরি শেষ হওয়ার নয়, বরং এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া,"—বলেন ড. ইউনূস।
তিনি আরো বলেন, "ধরুন, আমরা বিচার বা সংস্কার না করে সরাসরি নির্বাচন করি। তাহলে নির্বাচনের পর সব ক্ষমতা চলে যাবে নির্বাচিতদের হাতে। তখন আগের ব্যবস্থাই আবার ফিরে আসবে। আমাদের কাজ তখন অর্থহীন হয়ে যাবে।"
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি কড়া ভাষায় বলেন, "তিনি রাস্তায় মানুষ হত্যা করেছেন। আমি তাকে দানব বলেছি। যদি আরও শক্তিশালী কোনো শব্দ থাকত, তাহলে আমি সেটাই ব্যবহার করতাম।" ড. ইউনূস মনে করেন, "শেখ হাসিনাকে আর অস্থিরতা তৈরির সুযোগ দেওয়া উচিত নয়। তার ভাগ্য নির্ধারণ করবে বিচার।"
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়েও তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দেন। বলেন, "বাংলাদেশের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক প্রয়োজন। আমরা চীন, পাকিস্তানের সঙ্গে যেমন ভালো সম্পর্ক চাই, তেমনি ভারতের সঙ্গেও গভীর বন্ধন চাই। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক কখনোই খারাপ হয়নি।"
এ প্রসঙ্গে তিনি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরে বলেন, "নেপাল এবং ভুটানের পাশাপাশি ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যকেও একটি আঞ্চলিক অর্থনৈতিক অঞ্চলে অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব। এতে সব দেশই উপকৃত হবে।"
তার দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ও ভারতের ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। "বাংলাদেশের মানচিত্র না আঁকলে ভারতের মানচিত্রও আঁকা সম্ভব নয়,"—বলেই তিনি যোগ করেন, "এই দুই দেশের সম্পর্ক গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গোপসাগরকেন্দ্রিক অঞ্চলজুড়ে একটি যৌথ অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব।"
সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, "যখন আন্দোলনের সময় আমাকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানানো হয়, তখন আমি বাংলাদেশে ছিলাম না। প্রথমে রাজি হইনি। কিন্তু ছাত্ররা যখন বলেন, আপনি দূরে বসে জীবনের স্বাচ্ছন্দ্য উপভোগ করছেন, আর আমরা রক্ত দিচ্ছি—তখন আমি না করতে পারিনি।"
এই আহ্বান এবং সংকটকালে দেশের জন্য কিছু করার তাগিদ থেকেই তিনি নেতৃত্ব দিতে সম্মত হন বলে জানান।
ড. ইউনূস মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় টেকসই পরিবর্তন আনা। তিনি বলেন, "এই পরিবর্তনের একমাত্র পথ—গঠনমূলক সংস্কার, ন্যায়বিচার এবং জনগণের অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। তবে সেটা হতে হবে সুস্থ, পরিপূর্ণ রাজনৈতিক পরিবেশে, যেখানে আগের শোষণমূলক ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি হবে না।"