চলতি গ্রীষ্মে ভূমধ্যসাগর পাড়ের দ্বীপ লাম্পেদুসায় সূর্যের তেজ যেন চোখ রাঙাচ্ছে। ইতালির দক্ষিণাঞ্চল সিসিলি দ্বীপপুঞ্জের অংশ এই ছোট্ট দ্বীপ। মাসখানেক আগে এখানকার তীরে পৌঁছেছেন কয়েকজন বাংলাদেশি ও সুদানি তরুণ, যারা লিবিয়ার ভয়ংকর দিনগুলো পেছনে ফেলে এসেছেন। তাদের চোখে এখনও বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।
লাম্পেদুসায় আশ্রয় দিয়েছে আগ্রিজেন্তোর একটি স্থানীয় গির্জা। গির্জার আয়োজিত গ্রীষ্মকালীন নানা কর্মসূচিতে মেতে আছে এলাকার শিশুরা। প্রখর রোদ উপেক্ষা করে তারা ফুটবল খেলছে মাঠে। এক পাশে ছায়ায় বসে সেই খেলা দেখছিলেন সদ্য সাগর পাড়ি দেওয়া অভিবাসী তরুণেরা।
ইতালির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ২৫ জুলাই পর্যন্ত ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে দেশটিতে আসা অভিবাসীর সংখ্যা ৩৫ হাজার ৭৯২ জন। এর মধ্যে বাংলাদেশিরাই শীর্ষে—এসেছেন ১০ হাজার ৯৮৯ জন। পরের অবস্থানে ইরিত্রিয়া ও মিশরের নাগরিকেরা।
তপ্ত দুপুরে কথা হলো বাংলাদেশ থেকে আসা ১৭ বছর বয়সী রহিমের* সঙ্গে। লিবিয়ায় তার অভিজ্ঞতা, পাচারের শিকার হয়ে হাতবদলের গল্প শুনতে শুনতে বোঝা গেল—সেই স্মৃতি আজও তাকে কাঁপিয়ে দেয়।
রহিম বলেন, ‘এ বছরের ২৫ জুন আমরা লাম্পেদুসায় পৌঁছেছি। আমাদের উদ্ধার করে ইতালির একটি সামরিক জাহাজ। জুওয়ারা থেকে একটি কাঠের নৌকা নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম আমরা।’
ইতালি আসার আগে টানা ১৪ মাস লিবিয়ায় কাটিয়েছেন তিনি। ‘এই সময়ের মধ্যে আমরা তিনবার জায়গা বদল করেছি,’ জানালেন রহিম। এই সময়ের কিছুদিন তিনি ছিলেন ত্রিপোলি, সাব্রাথা ও জুওয়ারায়।
এতবার স্থান পরিবর্তনের কারণও বললেন, ‘লিবীয় পাচারকারীরা বাংলাদেশি মাফিয়ার সঙ্গে মিলে আমাদের একস্থান থেকে অন্য স্থানে সরিয়ে নিয়ে গেছে।’
রহিমের যাত্রা শুরু ২০২৪ সালের ৩ মার্চ, মাদারীপুরের কালিকাপুর গ্রাম থেকে। প্রথমে ঢাকা থেকে দুবাই, সেখান থেকে মিশরের আলেকজান্দ্রায় পৌঁছান তারা। লিবিয়া যাওয়ার আগে সেখানে কয়েকদিন আটকে রাখা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের সীমান্ত সুরক্ষা সংস্থা ফ্রন্টেক্সও নিশ্চিত করেছে—বাংলাদেশিদের লিবিয়ায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আলেকজান্দ্রা একটি গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্ট।
ত্রিপোলিতে প্রথম অবস্থানের পর এক পাচারকারী তাকে সাব্রাথায় নিয়ে যায়। সেখানেই শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। রহিমের ভাষায়, ‘আমাদের সবাইকে ওই ঘরে আটকে রাখা হয়েছিল। আমার মতো অনেক তরুণ সেখানে ছিলেন। বয়স্করাও ছিলেন। তারা আমাদের খাবার দিতো না এবং আমাদের মারধর করতো। পরে আমাদের তিনটি আলাদা কক্ষে ভাগ করা হয়েছিল। তিন জন লিবিয়ান নাগরিক এবং এক বাংলাদেশি ওই ঘরটির দেখাশোনার দায়িত্বে ছিল।’
পরিস্থিতি ছিল ভয়ংকর। ‘তারা আমাদের পরিবারের ফোন নম্বর জানতে চেয়েছিল। আমাদের মারধর করার সময় পরিবারের কাছে টাকা চেয়ে ভিডিও কল দিয়েছিল। তারা প্রায় এক হাজার ইউরো চেয়েছিল এবং তারা বলেছিল যে সাত দিনের মধ্যে টাকা দিতে হবে। আমার পরিবারের কাছে টাকা ছিল না, তাই তারা আমাকে মারধর করে এবং আমার একটি নখ উপড়ে ফেলে। তারপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি এবং পরে কী হয়েছিল আমার আর মনে নেই।’
রহিম ডান হাতের আঙুল দেখালেন, যেখানে এখনও নির্যাতনের দাগ রয়ে গেছে। ‘তারা ছয় মাস ধরে প্রতিদিন আমাদের মারধর করে, রাত ৩টায় আমাদের মারধর করা হতো, তখন বাংলাদেশে সকাল ৭টা। আর ভিডিও কল দিয়ে সেই দৃশ্য দেখিয়ে টাকা দাবি করতো।’
তার মা নেই, বাবা অসুস্থ, আর আছে দুই ছোট ভাই। তাই তিনি বললেন, ‘আমি পাচারকারীকে আমার খালার নম্বর দিয়েছিলাম। কারণ আমি চাইনি আমার বাবা এটা দেখুক।’
গলা ভারী হয়ে এল রহিমের—‘আমার পরিবার দরিদ্র এবং আমার একমাত্র ইচ্ছা হলো আমার বাবা এবং ভাইদের উন্নত জীবনযাপনে সাহায্য করা। আমি তাদের শান্তিতে রাখতে চাই।’
সাব্রাথা থেকে জুনে তাদের জুওয়ারায় নিয়ে যাওয়া হয়। রহিম বলেন, ‘রাতে জুওয়ারার এক মরুভূমিতে রাখা হয় আমাদের। সেখান থেকে হেঁটে এক মসজিদে পৌঁছাই আমরা। সেখানে হাজার খানেক বাংলাদেশি ছিলেন।’ সেখান থেকেই শুরু হয় ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি।
৯ জুন আন্তর্জাতিক জলসীমা থেকে গার্ডিয়া ডি ফিনাঞ্জা ৮৯ জন অভিবাসীকে উদ্ধার করে, যার মধ্যে ২৮ জন বাংলাদেশি। তাদের একজন রহিম।
ইতালি পর্যন্ত যাত্রার কথা ভাবলে এখনও অবিশ্বাস লাগে তার। রহিম বললেন, ‘আমি কখনও এই অমানবিক আচরণের কথা ভাবতে পারিনি। যখন আমি আমার গ্রামে ছিলাম, তখন আমি কখনও ভাবতে পারিনি লিবিয়া আসলে বাংলাদেশিদের জন্য কোন পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। বিশ্বের সবার জানা উচিত লিবিয়ায় বাংলাদেশিদের সঙ্গে কী ঘটে।’
তার কণ্ঠে প্রশ্ন—‘মানুষ কীভাবে অন্য মানুষের ওপর এভাবে অত্যাচার করতে পারে?’
এখন রহিমের সময় কাটছে ৮০ বছর বয়সী সিস্টার আউসিলিয়ার স্নেহে, যিনি লাম্পেদুসার মোলো ফাভালোরোতে অভিবাসীদের সহায়তায় কাজ করছেন তিন বছর ধরে। রহিম বলেন, ‘তিনি আমার মা।’
পোস্টকার্ডে লেখা দেখালেন তিনি—‘আউসিলিয়া ই ব্রাভা, তি আমো’—অর্থাৎ ‘আউসিলিয়া খুব ভালো, আমি তোমাকে ভালোবাসি।’
লাম্পেদুসায় এক মাসেরও বেশি সময় পার করে ফেলেছেন রহিম। ইতালিয়ান ভাষার কিছু শব্দও শিখেছেন। তার স্বপ্ন—‘আমি পড়াশোনা করতে চাই, তারপর একটি চাকরি খুঁজে বের করব যেন পরিবারকে সহযোগিতা করতে পারি। আমার বাবা এবং ভাইদের জন্য আমি সর্বোচ্চ করতে চাই।’
*নিরাপত্তার কারণে ‘রহিম’ ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।