৩ আগস্ট ২০২৫, ০১:০৮ এ.এম

প্রবাসে প্রতারণার বেড়াজাল ভাঙতে দূতাবাসের ‘ভিসা সত্যায়ন’

প্রবাসে প্রতারণার বেড়াজাল ভাঙতে দূতাবাসের ‘ভিসা সত্যায়ন’

মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশ কুয়েত—বছরের পর বছর ধরে লাখো বাংলাদেশির জন্য জীবনের মোড় ঘোরানোর সম্ভাবনার নাম। কিন্তু এই সম্ভাবনার পথ সবসময় মসৃণ ছিল না। সঠিক তথ্যের অভাব, অসাধু দালালচক্রের প্রতারণা, নিয়োগকর্তার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ—সব মিলিয়ে বহু বাংলাদেশির প্রবাস-স্বপ্ন পরিণত হয়েছে দুঃস্বপ্নে।

এই বাস্তবতায় কুয়েতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মেজর জেনারেল সৈয়দ তারেক হোসেন গ্রহণ করেছেন এক যুগান্তকারী উদ্যোগ—‘ভিসা সত্যায়ন ব্যবস্থা’। এ ব্যবস্থায় কুয়েতগামী কর্মীরা এখন দেশ ছাড়ার আগেই দূতাবাসের মাধ্যমে যাচাই করিয়ে নিতে পারছেন নিয়োগকর্তা ও কোম্পানির বিশ্বাসযোগ্যতা।
এর মাধ্যমে কেবল শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত হচ্ছে না, কমে যাচ্ছে দালালচক্রের দৌরাত্ম্যও।

ভিসার আড়ালে ছিল প্রতারণা, নতুন পদ্ধতিতে মিলছে সুরক্ষা

অতীতে বহু কর্মী কুয়েত এসেই বুঝেছেন—যে কোম্পানির নামে তারা এসেছেন, সেই কোম্পানির কোনো অস্তিত্বই নেই, বা চুক্তির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ। ফলে ভিসা বৈধ হলেও তারা হয়ে পড়েন কর্মহীন, অবৈধ এবং ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে।

শহীদুল ইসলাম, কুয়েতের একটি জাতীয় কোম্পানির সুপারভাইজার, নিজের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এভাবে—

“আমি কয়েকজন আত্মীয়কে ভিসা কিনে কুয়েতে এনেছিলাম। পরে জানতে পারি, যেই কোম্পানির নামে তারা এসেছে, তাদের কন্ট্রাক্টই শেষ হয়ে গেছে। চাকরি নেই, আকামা নেই। শেষমেশ বাধ্য হয়ে অনেক টাকা খরচ করে অন্য কোম্পানিতে রেসিডেন্সি করতে হয়।”

কিন্তু রাষ্ট্রদূত সৈয়দ তারেক হোসেনের নেতৃত্বে গৃহীত নতুন পদ্ধতিতে এমন প্রতারণা রোধে দূতাবাস সরাসরি ভূমিকা নিচ্ছে। এখন কোম্পানির চুক্তিপত্র, কাজের পরিবেশ, থাকার ব্যবস্থা ইত্যাদি সরেজমিনে পরিদর্শন করে তবেই ভিসা সত্যায়ন করা হচ্ছে। এতে শ্রমিক যেমন তথ্যপ্রাপ্ত হচ্ছেন, তেমনি নিয়োগকর্তাও থাকছেন জবাবদিহিতার আওতায়।

“এই উদ্যোগ বাঁচাবে হাজারো পরিবার” — বলছেন প্রবাসীরা

এই পদক্ষেপকে প্রবাসীরা দেখছেন জীবনের নিরাপত্তা এবং মর্যাদা রক্ষার চাবিকাঠি হিসেবে। মঈন উদ্দিন সরকার সুমন, বাংলাদেশ প্রেসক্লাব কুয়েতের সভাপতি বলেন, “ভিসা দূতাবাসে সত্যায়িত হলে, নতুন কর্মীদের অন্তত দুই বছর আকামা বা চাকরি হারানোর ভয় থাকবে না। বৈধভাবে আসা হাজারো প্রবাসী অবৈধ হওয়া থেকে রক্ষা পাবেন। সবচেয়ে বড় কথা, কোনো সমস্যা হলে এখন দূতাবাস সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবে।” জাহাঙ্গীর খান পলাশ, সভাপতি, বাংলাদেশ ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন কুয়েত, মনে করেন—“দূতাবাসের এমন উদ্যোগ কুয়েতগামী শ্রমিকদের জন্য অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক। তবে এটিকে দীর্ঘস্থায়ী করতে হলে কঠোর তদারকি ও দেশে-বিদেশে দালালদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে।”

দালালচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইও শুরু

প্রবাসীদের কল্যাণে এই উদ্যোগ যেমন প্রশংসিত, তেমনি এটির বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী অসাধু চক্র।
দূতাবাস সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ভেতরেই কিছু দালালচক্র ভিসা সত্যায়ন না করেই ঢাকা বিমানবন্দর দিয়ে নতুন শ্রমিকদের পার করার চেষ্টা করছে। তারা চায় পুরনো দুর্ব্যবস্থাই বহাল থাকুক—যেখানে মুনাফা আসে শ্রমিকের সর্বনাশের বিনিময়ে।

স্থায়ীত্ব ও আইনগত কাঠামোর দাবি

কুয়েতে অবস্থানরত বাংলাদেশি সংগঠনগুলো রাষ্ট্রদূতের এই উদ্যোগকে শুধু স্বাগতই জানায়নি, বরং এটিকে স্থায়ী করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদনও জানিয়েছে। তাদের একটাই দাবি—“এই ব্যবস্থা যেন কোনো চাপের মুখে উঠে না যায়। এটিকে যেন প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীনে আইনি কাঠামোয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়।”

রাষ্ট্রদূত সৈয়দ তারেক হোসেনের এই উদ্যোগ নিছক একটি প্রশাসনিক পদক্ষেপ নয়—এটি একাধারে শ্রমিকের অধিকার রক্ষার লড়াই, দালালচক্রের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং বাংলাদেশের ভাবমূর্তি রক্ষার কৌশল। যদি এটিকে শক্ত হাতে বাস্তবায়ন করা হয় এবং রাজনৈতিক প্রভাব ও দুর্নীতির বাইরে রাখা যায়, তবে এটি হতে পারে মধ্যপ্রাচ্যে প্রবাসী নীতিমালার এক নতুন মডেল।