৩১ জুলাই ২০২৫, ১০:৫৪ পি.এম

পৃথিবীর বাহিরে কি প্রাণের অস্তিত্ব আছে?

পৃথিবীর বাহিরে কি প্রাণের অস্তিত্ব আছে?

পৃথিবীর বাইরে আর কোথাও মানুষ আছে? মানুষ না হোক, অন্তত অন্য কোনো প্রাণী বা প্রাণের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব? এখনই এই প্রশ্নের উত্তর জানাতে না পারলেও আশা দেখাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। একটি গ্রহের খোঁজ পেয়েছেন জানিয়ে তারা বলছেন, পৃথিবী থেকে অনেক দূরের অন্য এক নক্ষত্রের চারপাশে ঘুরতে থাকা সেই গ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব থাকতে পারে বলে শক্তিশালী প্রমাণ পেয়েছেন।

কে২-১৮বি নামের একটি গ্রহের বায়ুমণ্ডল নিয়ে গবেষণা করছেন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষক দল। তারা গ্রহটির বায়ুমণ্ডলে এমন কিছু অণুর উপস্থিতি শনাক্ত করেছেন যা পৃথিবীতে কেবল সরল বা এক কোষী (উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে ব্যাকটেরিয়া) জীবের মাধ্যমেই তৈরি হয়।

এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো, একইসঙ্গে আগের চেয়েও বেশি আশাব্যঞ্জকভাবে নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (জেডব্লিউএসটি) ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডলে জীবনের সাথে সম্পর্কিত রাসায়নিক উপাদান শনাক্ত করেছে।

তবে এই ফলাফল নিশ্চিত করতে আরও তথ্য প্রয়োজন বলে জানিয়েছে গবেষণা দলটি, স্বাধীনভাবে কাজ করেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও একই মত দিয়েছেন।

শিগগিরই নিশ্চিত প্রমাণ পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন প্রধান গবেষক অধ্যাপক নিক্কু মধুসূদন। পৃথিবীর বাইরেও কি প্রাণের অস্তিত্ব আছে, কী বলছেন বিজ্ঞানীরা?

 

আকারের দিক থেকে কে২-১৮বি পৃথিবীর তুলনায় আড়াই গুণ বড়। এটি আমাদের থেকে ৭০০ ট্রিলিয়ন মাইল, অর্থাৎ ১২৪ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। এর মানে দাঁড়ায়— কোনো মানুষের পক্ষে সেখানে এক জীবনে পৌঁছানো সম্ভব না।

কিন্তু জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ এতটাই শক্তিশালী যে একটি ছোটো লাল সূর্যের চারপাশে ঘূর্ণায়মান ওই গ্রহ অতিক্রম করে আসা আলো বিশ্লেষণ করে ওই গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের রাসায়নিক গঠন বিশ্লেষণ করতে পারে।

কেমব্রিজের গবেষক দলটি দেখেছে যে গ্রহটির বায়ুমণ্ডলের দুটি অণুর মধ্যে অন্তত একটির মধ্যে এমন রাসায়নিক চিহ্ন রয়েছে যেগুলো সাধারণত জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত; এই রাসায়নিকগুলো হলো- ডাইমিথাইল সালফাইড (ডিএমএস) এবং ডাইমিথাইল ডিসালফাইড (ডিএমডিএস)।

পৃথিবীতে এই গ্যাসগুলো সামুদ্রিক ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন ও ব্যাকটেরিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয়।

একটি পর্যবেক্ষণেই এই গ্যাসের এতটা উপস্থিতি দেখে নিজের বিস্ময়ের কথা জানান অধ্যাপক মধুসূদন।

"বায়ুমণ্ডলটিতে যে পরিমাণ গ্যাস আছে বলে আমরা ধারণা করছি, তা পৃথিবীর চেয়ে হাজার গুণ বেশি", বলেন তিনি।

"ফলে এই গ্যাস যদি আসলেই জীবনের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়, তাহলে গ্রহটিতে জীবনের প্রাচুর্য থাকবে," তিনি আরও বলেন।

ছবির ক্যাপশান,ভীনগ্রহে বা ভিন্ন জগতে প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানীরা

আরও এক ধাপ এগিয়ে অধ্যাপক মধুসূদন বলেন, "আমরা যদি কে২-১৮বি গ্রহে জীবন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারি তার মানে এটাই দাঁড়াবে যে ছায়াপথে জীবন থাকাটাই স্বাভাবিক।"

গত বৃহস্পতিবার বিবিসি রেডিও ফাইভের লাইভে তিনি বলেন, "এটা বিজ্ঞানের জন্য এবং একাধারে প্রাণী হিসেবে আমাদের জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক মুহূর্ত।"

"এমন যদি একটা উদাহরণ মেলে, তাহলে বুঝতে হবে- এই অসীম মহাবিশ্বে আরও অনেক গ্রহেই জীবনের সম্ভাবনা রয়েছে।"

এ নিয়ে কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের প্রভাষক এবং গবেষণা দলের সদস্য ড. সুবীর সরকার বলেন, গবেষণায় কে২-১৮বি'তে প্রাণে ভরপুর সমুদ্র থাকার ইঙ্গিত রয়েছে; যদিও বিজ্ঞানীরা এখনও "নিশ্চিতভাবে কিছু বলতে পারছেন না" বলেও সতর্ক করে দেন তিনি।

তিনি আরও বলেন, গবেষণা দলটি অন্যান্য গ্রহেও প্রাণের খোঁজ অব্যাহত রাখবে।

ছবির ক্যাপশান,জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ শত শত ট্রিলিয়ন মাইল দূরে অবস্থিত গ্রহের বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী

তবে এখনও অনেক 'যদি' ও 'কিন্তু' থাকার বিষয়টি অধ্যাপক মধুসূদনের দল অকপটে স্বীকার করেছেন।

প্রথমত, নতুন এই অনুসন্ধান এখনও এমন জায়গায় পৌঁছায়নি যেখানে এটাকে চূড়ান্ত আবিষ্কার হিসেবে দাবি করা যায়।

আবিষ্কার হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে গবেষকদের ৯৯.৯৯৯৯৯ শতাংশ নিশ্চিত হতে হবে যে ফলাফলটি সঠিক এবং কোনো দৈব ঘটনা নয়। বিজ্ঞানের পরিভাষায় একে "ফাইভ সিগমা" ফলাফল বলে।

বর্তমানে পাওয়া ফলাফলটি কেবল "থ্রি সিগমা" অর্থাৎ ৯৯ দশমিক ৭ শতাংশ নিশ্চিত। শুনতে অনেক মনে হলেও বৈজ্ঞানিক গোষ্ঠীকে সন্তুষ্ট করার জন্য তা যথেষ্ট নয়।

তবে ১৮ মাস আগে পাওয়া ওয়ান সিগমা বা ৬৮ শতাংশ ফলাফলের তুলনায় অনেক এটা বেশি, যা নিয়ে সেসময় ব্যাপক সংশয় দেখা দিয়েছিল।

তবে কেমব্রিজের গবেষকরা যদি ফাইভ সিগমা ফলাফলও অর্জন করেনও তবুও তা গ্রহটিতে জীবন থাকার চূড়ান্ত প্রমাণ হবে না — এমনটাই জানিয়েছেন এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও স্কটল্যান্ডের অ্যাস্ট্রোনোমার রয়্যাল ক্যাথরিন হেইম্যানস। তিনি গবেষণা দলটির সঙ্গে যুক্ত নন।

বিবিসি নিউজকে তিনি বলেন, "নিশ্চিত হলেও এই গ্যাসের উৎপত্তিস্থল কী —তখনও এই প্রশ্ন থেকে যাবে।"

"পৃথিবীতে এটি সামুদ্রিক অণুজীব দ্বারা তৈরি হয়, কিন্তু নিখুঁত তথ্য পেলেও আমরা নিশ্চিতভাবে বলতে পারব না যে এটি ভিন্ন একটি গ্রহে জৈবিক কোনো উৎস থেকেই এসেছে। কারণ মহাবিশ্বে বহু অজানা বিষয় ঘটে, আর আমরা জানি না সেই গ্রহে এমন কী ভূতাত্ত্বিক ঘটনা ঘটছে যা এই গ্যাস তৈরি করতে পারে।"

কেমব্রিজের দলও এই দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একমত। অণুজীব ছাড়া ডিএমএস আর ডিএমডিএস অন্যভাবে অর্থাৎ অজৈব পদ্ধতিতে ল্যাবে তৈরি করা যায় কি না সেটি দেখতে তারা এখন অন্য গবেষণা দলগুলোর সঙ্গে কাজ করছে।

অধ্যাপক মধুসূদন বলেন, "এখনও শূন্য দশমিক তিন শতাংশ পরিসংখ্যানগত ভ্রান্তি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।"

ভিনগ্রহে প্রাণ থাকতে পারে — এমন দাবি "সত্য হলে তা অনেক বড় একটি বিষয়" উল্লেখ করে বিবিসি রেডিও ফোরের টুডে অনুষ্ঠানে তিনি বলেন: "তাই আমরা খুবই সতর্কভাবে কাজ করতে চাই, আরও পর্যবেক্ষণ করতে চাই এবং এমন পর্যায়ে প্রমাণ নিতে চাই যেখানে দৈবভাবে এ ফলাফল পাওয়ার সম্ভাবনা এক মিলিয়নের মধ্যে একটিরও কম হয়।"

তার মতে, "সম্ভবত এক বা দুই বছরের" মধ্যেই এটি সম্ভব হবে ।

এদিকে অন্য গবেষক দলগুলো কে২-১৮বি গ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের বিষয়টি ছাড়াও আরও কিছু বিকল্প ব্যাখ্যা দিয়েছেন। শুধু ডিএমএস আর ডিএমডিএস এর উপস্থিতি নিয়েই নয়, বরং এই গ্রহের প্রকৃতি নিয়েও জোরালো বৈজ্ঞানিক বিতর্ক চলছে।

অনেক গবেষকের মতে, গ্রহের বায়ুমণ্ডলে অ্যামোনিয়া গ্যাসের অনুপস্থিতি থাকার কারণে গ্রহটিতে বড় তরল জলাধার বা মহাসাগর থাকতে পারে। তাদের তত্ত্ব হলো, বিশাল জলাধারের নিচে অ্যামোনিয়া শোষিত হয়েছে।

তবে কেমব্রিজের অধ্যাপক অলিভার শর্টল বলছেন, এটা গলিত শিলার সমুদ্র হওয়ার সম্ভাবনাও আছে, যা হলে প্রাণের অস্তিত্ব থাকা অসম্ভব।

"আমরা ভিনগ্রহগুলোর সম্পর্কে যা কিছু জানি সবই ওই গ্রহের বায়ুমণ্ডল থেকে প্রতিফলিত সামান্য পরিমাণ আলো বিশ্লেষণ করে। তাই এটি একটি ভীষণ দুর্বল সংকেত এবং এখান থেকেই আমাদের শুধু প্রাণ নয়, সবকিছু বোঝার চেষ্টা করতে হচ্ছে," বলেন তিনি।

"কে২-১৮বি নিয়ে বৈজ্ঞানিক বিতর্ক মূলত গ্রহটির গঠন ঘিরেই", যোগ করেন তিনি।

এদিকে নাসার অ্যামস রিসার্চ সেন্টারের ড. নিকোলাস ওয়াগন একটি ভিন্ন ব্যাখা দিয়েছেন। তার প্রকাশিত গবেষণা বলছে, কোনো শক্ত পৃষ্ঠ ছাড়াই কে২-১৮বি ছোটো গ্যাসে ভরপুর হতে পারে।

তবে এসব বিকল্প তত্ত্বও জেডব্লিউএসটি'র ডেটার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে যুক্তি দিচ্ছেন অন্য গবেষকরা — যার ফলে কে২-১৮বি নিয়ে বৈজ্ঞানিক বিতর্ক আরও জোরদার হয়েছে।

বিবিসির দ্য স্কাই এট নাইট অনুষ্ঠানের উপস্থাপক অধ্যাপক ক্রিস লিনটট জানান, অধ্যাপক মধুসূদনের দলের প্রতি তার "অপরিসীম শ্রদ্ধা" থাকলেও গবেষণাটি নিয়ে তিনি সতর্ক অবস্থান নিচ্ছেন।

"এটাকে 'একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত' হিসেবে দাবি করার বিষয়ে আমরা খুব সতর্ক থাকতে চাই। অতীতেও আমরা এমন মুহূর্তের মুখোমুখি হয়েছি", বলেন তিনি।

তার মতে, মহাবিশ্বে কী আছে তা বোঝার বৃহত্তর প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে গবেষণাটিকে দেখা উচিত।

অধ্যাপক মধুসূদন স্বীকার করেছেন যে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য এখনও বিশাল বৈজ্ঞানিক চ্যালেঞ্জ পাড়ি দেয়া বাকি। তবে তার বিশ্বাস, তিনি ও তার দল সঠিক পথে আছেন।

তিনি বলেন, "এখন থেকে বহু দশক পরে আমরা হয়তো এই সময়টিকে জীবন্ত মহাবিশ্ব আমাদের নাগালের মধ্যে আসার মুহূর্ত হিসেবে মনে করব।"

"এটাই হতে পারে সেই মুহূর্ত, যখন 'আমরা কি এই মহাবিশ্বে একা?' — এই মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়ে উঠবে।"

 

দ্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নাল লেটারসে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে।