আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। প্রকৃত নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। কৈশোরেই তাঁর সাহিত্যচর্চার শুরু, বিশেষত গণমানুষের ভাষায় কবিতা রচনার প্রতি ঝোঁক ছিল প্রবল।
আল মাহমুদের কাব্যজগৎকে কয়েকটি ধাপে বিশ্লেষণ করা যায়:
১. লোকজ ও মাটির ঘ্রাণ: তাঁর প্রথম দিককার কবিতায় রয়েছে গ্রামীণ বাংলার চিত্র, প্রকৃতি, কৃষিজীবনের ছায়া। যেমন:
“ধান খেতে যেন কেবল নারীর শরীর, আর নদী মানে ঘরের টানাপোড়েন।”
২. ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক চেতনা: মুক্তিযুদ্ধ, ঔপনিবেশিকতা, ইসলামী চেতনা—এসব কিছুর সম্মিলন দেখা যায় তাঁর পরবর্তী রচনায়। তাঁর কবিতায় বঙ্গবন্ধু থেকে শুরু করে শহীদ ও শোষিতদের কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হয়েছে।
৩. ইসলামী রেনেসাঁর বীজ: আশির দশকের পর তাঁর কবিতায় ইসলামী ভাবধারা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি ছিল এক নতুন ধারা—যেখানে ধর্মীয় ভাবনা কাব্যিক রূপ লাভ করে।
কবিতাগ্রন্থ:
লোক লোকান্তর (১৯৬৩)
কালের কলস (১৯৬৬)
সোনালি কাবিন (১৯৭৩)
মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো (১৯৮১)
গদ্যসাহিত্য:
কবির আত্মকথা
উপন্যাস: উপমহাদেশ, কাবিলের বোন, দেউলিয়া, দারবিশের কাগজ
নিবন্ধ ও ভাষণ:
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও ইসলাম নিয়ে তাঁর প্রবন্ধ-নিবন্ধ সমসাময়িক বুদ্ধিজীবী সমাজে আলোড়ন তোলে।
আল মাহমুদের কবিতায় একসঙ্গে দেখা যায়:
আরবি-ফারসি শব্দের সাবলীল ব্যবহার
গ্রামীণ উপমার সঙ্গে নাগরিক বাস্তবতার মিলন
নারী, প্রেম ও বিপ্লবের পারস্পরিক গাঁথুনি
তাঁর ভাষা সাহসী, আবেগতাড়িত এবং আন্তরিক। তাঁর কবিতায় প্রেম মানে নিছক রোমান্স নয়—এটা কখনও মাতৃভূমির প্রতি প্রেম, কখনও ঈশ্বরের প্রতি আকুতি।
আল মাহমুদ ছিলেন মতাদর্শগতভাবে স্পষ্ট এবং অকম্প। একসময় বাম রাজনীতির কাছাকাছি থাকলেও পরবর্তীতে ইসলামী ভাবনার দিকে ঝুঁকে পড়ায় বামপন্থী কিছু কাপুরুষদের দ্বারা সমালোচনার শিকার হন। অনেক বামপন্থী সাহিত্যিক তাঁকে মৌলবাদী বলে কটাক্ষ করে যদিও আল মাহমুদ কখনো উগ্রবাদী ছিলেন না। কেবল ইসলামী ভাবনার দিকে ঝুঁকে পড়ার কারণে আল মাহমুদকে নানা অবহেলা ও অবজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছিল। তিনি জীবিত থাকাকালে তাকে প্রাপ্য মূল্যায়ন করেনি তৎকালীন জনধীকৃত স্বৈরাচারী সরকার।েএই কাজে প্ররোচনা দিয়েছে কিছু নীতিভ্রষ্ট বামপন্থী সেক্যুলাররা। তবে এতকিছুর পরও বামেরা অস্বীকার করতে পারেননি—বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের কণ্ঠ ছিল একেবারে আলাদা ও শক্তিশালী।
আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যে এমন একটি কণ্ঠস্বর যার চিত্রকল্প, শব্দচয়ন ও আবেগের শক্তি নতুন প্রজন্মের কবিদের গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তাঁর কবিতা আজও বাংলাদেশ ও বিশ্বের বাঙালি পাঠকমননে আলোড়ন তোলে।
আল মাহমুদ ছিলেন সাহিত্যের শাণিত তরবারি, যিনি প্রেম, প্রতিবাদ ও প্রার্থনার কণ্ঠে বাঙালির আত্মার ইতিহাস লিখে গেছেন। তিনি আমাদের কবিতা দিয়েছেন, প্রতিবাদ শিখিয়েছেন, আবার নীরব আত্মদহনও দেখিয়েছেন। আল মাহমুদকে তাই শুধু কবি নয়—একজন সময়প্রবাহের ঐতিহাসিক বলে স্মরণ করা উচিত।