ফররুখ আহমেদ (১৯১৮–১৯৭৪) বাংলা সাহিত্যের এক বিশিষ্ট কবি, যিনি আধুনিক কালে ইসলামী ভাবধারার কাব্যধারাকে পুনরুজ্জীবিত করেছেন। তাঁর কবিতা যেমন চেতনাসম্পন্ন ও ভাবগম্ভীর, তেমনি সৌন্দর্য-অনুরাগ, দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধে উজ্জ্বল। সাহিত্যজগতে তিনি ‘ইসলামী চেতনার কবি’ হিসেবে পরিচিত হলেও, ফররুখ আহমেদের কবিতা নিছক ধর্মীয় বয়ান নয়—তা ছিল সমাজ, ইতিহাস ও মনুষ্যত্বের গভীর অনুধ্যান।
ফররুখ আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯১৮ সালের ১০ জুন, মাগুরা জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাঝাইল গ্রামে। তাঁর পিতা সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন একজন আইনজীবী। ফররুখ খুলনা জেলা স্কুলে পড়াশোনা শেষে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি লাভ করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি সাহিত্য ও রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন।
ফররুখ আহমেদের সাহিত্যজীবন শুরু হয় ১৯৪০-এর দশকে। প্রথম কাব্যগ্রন্থ "সাত সাগরের মাঝি" প্রকাশিত হয় ১৯৪৪ সালে। এই গ্রন্থই তাঁকে বাংলার কাব্যাঙ্গনে স্থায়ী আসন প্রদান করে। কাব্যটির নাম-কবিতায় ‘আমি সাত সাগরের মাঝি’ উচ্চারণের মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহর ইতিহাস, অভিযান এবং আত্মমর্যাদা উদ্ভাসিত হয়।
ফররুখ আহমেদের কবিতার কেন্দ্রবিন্দু হলো ইসলাম, ইতিহাস ও সমাজচেতনা। তিনি ইসলামী ঐতিহ্য, সাহস, ন্যায়, আত্মত্যাগ ও নেতৃত্বের গৌরবময় দিকগুলো তুলে ধরেছেন। একই সঙ্গে সমকালীন সমাজের অবক্ষয়, নৈতিকতা-সংকট এবং সাংস্কৃতিক দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন কাব্যিক ভাষায়। তাঁর কবিতা যেমন আধুনিক, তেমনি আধ্যাত্মিক।
প্রধান বৈশিষ্ট্য:
ইসলামী ভাবধারা ও ঐতিহ্য
আধুনিক ভাষাশৈলী ও প্রতীক ব্যবহার
আরবি-ফারসি শব্দের ব্যঞ্জনাময় প্রয়োগ
ঐতিহাসিক চেতনা ও প্রেরণা
ফররুখের কবিতায় বারবার ফিরে আসে আত্মজাগরণ ও প্রেরণার বার্তা। তিনি লিখেছেন—
“নবীন পাখিরা ডাকিছে বাঁকে বাঁকে তরুণ বাঙালি জাগো, এসো হুঁশ ফিরে আসে।”
সাত সাগরের মাঝি (১৯৪৪)
সিন্ধু দরিয়া (১৯৫৭)
নৌফেল ও হাতেম (১৯৬১)
ধূমকেতু (১৯৬১)
সিরাজাম মুনিরা (১৯৬৩)
মুহূর্তের কবিতা (১৯৬৫)
হামিদনগর (১৯৬৭)
এই গ্রন্থগুলোতে শুধু ইসলামী ভাবধারাই নয়, বরং একটি সমকালীন মুসলিম পরিচয়ের সংকট ও বিকাশের কাব্যিক রূপায়ণ পাওয়া যায়।
ফররুখের কাব্যে ইসলাম নিছক ধর্ম হিসেবে নয়, বরং একটি জীবনদর্শন ও সংস্কৃতি হিসেবে প্রতিভাত হয়েছে। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নকে সাহিত্যিক আলোচনার মূলধারায় নিয়ে আসেন। তাঁর কবিতা যেমন মসজিদের মিনার স্পর্শ করে, তেমনি পৃথিবীর নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।
পাকিস্তান আন্দোলনের সময় ফররুখ আহমেদ মুসলমানদের জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের পক্ষে ছিলেন। তবে পাকিস্তানের বাস্তবতায় ধর্মনিরপেক্ষতা ও মানবিক মূল্যবোধের জায়গায় তিনি হতাশ হন। তাঁর কাব্যে ধীরে ধীরে প্রতিবাদ, হতাশা ও বঞ্চিত মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পায়। বাংলা সাহিত্যে তিনি এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, যিনি বলেন:
“গভীর ঘুমের ভিতরে জাতিরে জাগাও ভাই আলো দেখাও, শান্তির মন্ত্র শেখাও ভাই।”
ফররুখ আহমেদের কবিতায় মুসলিম নারীর মর্যাদা ও শিশুদের প্রতি ভালোবাসার প্রকাশ বিশেষভাবে লক্ষণীয়। ‘সিরাজাম মুনিরা’ কাব্যগ্রন্থে তিনি নারীকে জ্ঞানের আলোয় উদ্ভাসিত ও আত্মমর্যাদায় পরিপূর্ণ রূপে তুলে ধরেন। শিশুদের জন্য তাঁর কবিতা যেমন শিক্ষামূলক, তেমনি কল্পনাবিলাসী।
বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬০)
একুশে পদক (মরণোত্তর, ১৯৭৭)
আদমজী সাহিত্য পুরস্কার
ফররুখ আহমেদ ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর সাহিত্যিক উত্তরাধিকার আজও শক্তিশালী ও প্রাসঙ্গিক। তাঁর কবিতা পাঠে আমরা যেমন ইসলামের নান্দনিকতা আবিষ্কার করি, তেমনি খুঁজে পাই এক নতুন মানবতা ও ঐতিহাসিক সচেতনতা।
ফররুখ আহমেদ ছিলেন এক সাহিত্যিক যিনি ধর্ম, ইতিহাস ও সমাজকে এক সূত্রে গেঁথে এক অনন্য কাব্যভুবন নির্মাণ করেছেন। বাংলা কবিতায় তিনি ইসলামী ভাবধারাকে আধুনিক রূপে উপস্থাপন করেছেন, যা কেবল মুসলিম সমাজ নয়, বরং মানবজাতির জন্যও এক নৈতিক আহ্বান হয়ে ওঠে। তাঁর কবিতা শুধু অতীত স্মরণ নয়, বরং বর্তমানকে বুঝে ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রেরণা। ফররুখ আহমেদ বাংলা সাহিত্যে আজীবন স্মরণীয় নাম।