বাংলা সাহিত্যে মুসলিম চেতনার প্রথম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কদের মধ্যে কায়কোবাদ (১৮৫৭–১৯৫১) একজন বিশিষ্ট নাম। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে বাংলা ভাষায় মুসলিম সমাজের আত্মপরিচয় ও ইতিহাসবোধ গঠনের যে সাহিত্যিক আন্দোলন দেখা যায়, কায়কোবাদ সেখানে এক অগ্রপথিক। তাঁর কাব্য-প্রতিভা শুধু সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি নয়, একটি অবদমিত সম্প্রদায়ের আত্মমর্যাদাবোধ পুনর্গঠনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।
কায়কোবাদ জন্মগ্রহণ করেন ১৮৫৭ সালে, ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মুন্সী ওয়ালীউল্লাহ। তিনি প্রথাগত ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেন। উর্দু ও ফারসি সাহিত্যের প্রভাব তাঁর সাহিত্যচর্চায় ছাপ ফেললেও তিনি বাংলাকেই নিজের প্রকাশভাষা হিসেবে বেছে নেন।
কায়কোবাদ কাব্যচর্চা শুরু করেন অল্প বয়সেই। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ "বিরিঞ্চিবাবা" প্রকাশিত হয় ১৮৭০-এর দশকে। তবে তাঁর সাহিত্যিক খ্যাতির শিখরে পৌঁছান ১৯০৪ সালে প্রকাশিত "মহাশ্মশান" কাব্যের মাধ্যমে। এতে তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধের পটভূমিতে আহমদ শাহ আবদালির বীরত্বগাথা তুলে ধরা হয়েছে। এই যুদ্ধকে তিনি শুধু ইতিহাস নয়, মুসলিম জাতির আত্মরক্ষার প্রতীক হিসেবে দেখেছেন।
কায়কোবাদ বাংলা সাহিত্যে মুসলিমদের বীরত্ব, আত্মত্যাগ এবং গৌরবোজ্জ্বল অতীতের স্মৃতিকে পুনর্জাগরিত করেন। সে সময়কার বাংলা সাহিত্যে হিন্দু পুরাণ ও সংস্কৃতির আধিপত্য ছিল। কায়কোবাদ সেখানে মুসলিম ঐতিহ্যের মর্যাদা রক্ষায় সচেতন প্রয়াস নেন। তাঁর কাব্যে মুসলিম ইতিহাস, ইসলামি আদর্শ এবং ধর্মীয় অনুভূতির প্রকাশ স্পষ্ট। "মহাশ্মশান"-এ যেমন মুসলিম ঐতিহ্যের গৌরবগাথা রয়েছে, তেমনি অন্যান্য রচনায় যেমন "শিবমন্দির" ও "আব্দুল মজিদ"-এ তিনি মানবতা, ধর্মীয় ভাবধারা ও ইতিহাসের সম্মিলন ঘটিয়েছেন।
কায়কোবাদ অলঙ্কারময়, গম্ভীর ও দার্শনিক কাব্যভাষা প্রয়োগে সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাঁর রচনায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের প্রভাব থাকলেও তিনি ইসলামী ভাবধারাকে কেন্দ্রে রেখে কাব্য নির্মাণ করেছেন। তাঁর ভাষা কখনও শাসনামলীয় ফারসি-উর্দু শব্দে রঙিন, কখনও বা পুরাণ ও ঐতিহ্যবাহী আরবি ভাবসম্পন্ন। এই মিলন বাংলার মুসলিম পাঠকের কাছে একটি স্বাতন্ত্র্যচিহ্ন হয়ে উঠেছিল।
মহাশ্মশান
শিবমন্দির
আব্দুল মজিদ
বিরিঞ্চিবাবা
নলিনী
ডোমকলি
কুসুম কানন
প্রতিটি গ্রন্থেই কোনো না কোনোভাবে মানবতাবোধ, ধর্মীয়তা ও আত্মসচেতনতা যুক্ত হয়েছে।
বাংলা ভাষায় মুসলমানদের সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে কায়কোবাদ পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর কবিতায় যে বর্ণময় ইতিহাসবোধ ও আত্মমর্যাদার চেতনা ছিল, তা ঔপনিবেশিক সময়ের মুসলমানদের আত্মপরিচয় পুনর্গঠনে অনুপ্রেরণাস্বরূপ হয়। শুধু কাব্যপ্রেমী পাঠক নয়, শিক্ষিত মুসলিম মধ্যবিত্তের কাছেও তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাঁকে বলা হয় 'শায়র-ই-রুম'।
১৯২৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে "কাব্যতীর্থ" উপাধিতে ভূষিত করে। ১৯৫১ সালের ২১ জুলাই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তবে তাঁর সাহিত্যকীর্তি বাংলা মুসলিম সমাজে আজও মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত।
কায়কোবাদ ছিলেন একাধারে ইতিহাস-সচেতন, ধর্মনিষ্ঠ এবং ভাষাশৈলীর কারিগর। তাঁর কবিতা বাঙালি মুসলমানদের গৌরবময় ইতিহাস ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি। তিনি শুধু একজন কবি নন, বরং একজন চেতনার বাহক, যিনি সাহিত্যের মাধ্যমে একটি সমাজকে আত্মসচেতন করে তুলতে পেরেছিলেন। কায়কোবাদ বাংলা মুসলিম সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অপরিহার্য নাম, যাঁর উত্তরাধিকার আজও আমাদের সাহিত্য ও সমাজে প্রাসঙ্গিক।