২৮ জুলাই ২০২৫, ০৩:১৩ এ.এম

পাহাড়ে সন্ত্রাসী ছক: অস্ত্রের ছড়াছড়ি, জুমল্যান্ড গঠনের ষড়যন্ত্র

পাহাড়ে সন্ত্রাসী ছক: অস্ত্রের ছড়াছড়ি, জুমল্যান্ড গঠনের ষড়যন্ত্র

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা—খাগড়াছড়ি, বান্দরবান ও রাঙামাটিতে ফের অস্থিরতা ঘনীভূত হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার একাধিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে এখন বিপুল পরিমাণ আধুনিক ও প্রাণঘাতী অস্ত্র। এ অস্ত্রের ব্যবহারেই পাহাড়ে চাঁদাবাজি, খুন, গুম, অপহরণ ও রাজনৈতিক আধিপত্যের নতুন মঞ্চ তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলো—স্বাধীন ‘জুম্মল্যান্ড’ রাষ্ট্র গঠনের ষড়যন্ত্র এখন আবারও তৎপরতার পর্যায়ে।

“পাহাড়ে সন্ত্রাসীদের হাতে রয়েছে একে-৪৭, একে-৫৬, একে-২২, এম-১৬, মার্ক-২ রাইফেল, এম-৪ কার্বাইন, ৪০ এমএম গ্রেনেড লঞ্চার, চায়না রাইফেল, নাইন এমএম পিস্তল, এসএলআর, এসএমজি, এলজি, বিমানবিধ্বংসী রিমোট কন্ট্রোল বোমা, গ্রেনেড, হেভি মেশিনগান, জি-৩ রাইফেল, স্নাইপার রাইফেল। এ ছাড়াও রয়েছে রকেট লঞ্চার, বিভিন্ন ধরনের রাইফেল, হাতবোমা, শক্তিশালী ওয়াকিটকি, দেশি পিস্তল, বন্দুক এবং মর্টার। আছে ড্রোন, সিগন্যাল জ্যামারসহ অত্যাধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন সরঞ্জাম।”

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, খাগড়াছড়ির মণিপুর সীমান্তবর্তী তারাবন এলাকায় অবস্থিত এসব অস্ত্রের গুদাম। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর দাবি, এই বিশাল অস্ত্রভাণ্ডার ব্যবহৃত হচ্ছে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘জুম্মল্যান্ড’ প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্রে।

“খুন, গুম, চাঁদাবাজি, অপহরণ আর আধিপত্য বিস্তারে ব্যবহার করা হচ্ছে এসব অস্ত্র। অশান্ত হয়ে উঠছে পাহাড়। বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুত, চাঁদাবাজি আর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সন্ত্রাসীরা এখন স্বপ্ন দেখছে তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে স্বাধীন জুম্মল্যান্ড প্রতিষ্ঠার।”

সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার, সীমান্তে ষড়যন্ত্র

গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানিয়েছেন, ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরামের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামকে যুক্ত করে কল্পিত ‘জুম্মল্যান্ড’-এর মানচিত্র ছড়ানো হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।

“বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য ও বিবৃতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তাদের দাবিদাওয়ার পেছনে পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের অন্তর্নিহিত ষড়যন্ত্র লুকিয়ে আছে। ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম রাজ্যের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের মানচিত্র যোগ করে কল্পিত ‘জুম্মল্যান্ড’-এর মানচিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করা হচ্ছে। তারা জানান, ৫ আগস্ট সরকারের পট পরিবর্তনের পর দেশের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করার চেষ্টা করা হচ্ছে।”

চার সশস্ত্র সংগঠনের আধিপত্য

আঞ্চলিক চারটি সন্ত্রাসী সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘদিন ধরে অস্ত্র চালাচ্ছে। এরা হলো—ইউপিডিএফ (প্রসিত), ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক), জনসংহতি সমিতি (সন্তু লারমা বা মূল) ও জেএসএস (সংস্কার)।

“পাহাড়ে একচ্ছত্র আধিপত্য, চাঁদাবাজি ও ভূমি দখলের লক্ষ্যে অস্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে পাহাড়কে অশান্ত করে তুলেছে সন্ত্রাসীদের আঞ্চলিক চারটি সংগঠন।”

গোয়েন্দা তথ্য বলছে, শান্তিচুক্তির বিরোধিতাকারী এসব সংগঠন পার্বত্য এলাকায় নিয়মিত সশস্ত্র হামলা, হত্যা ও চাঁদাবাজি করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সংঘর্ষে অস্ত্রের ঘাটতি মেটাতে সীমান্ত দিয়ে নতুন অস্ত্র এনে আবার শক্তি বাড়িয়েছে তারা।

“সাম্প্রতিককালে আঞ্চলিক সংগঠনগুলোর মধ্যে সশস্ত্র সংঘর্ষ বেড়ে যাওয়ায় অস্ত্র ও গোলাবারুদের মজুত কমে যায়। ঘাটতি পূরণে তারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র থেকে অবৈধ পন্থায় অস্ত্র ও গোলাবারুদ আনছে। চাঁদাবাজির বড় অংশ অস্ত্র ও গোলাবারুদ কিনতে ব্যয় করা হচ্ছে।”

৭০০ কোটি টাকার চাঁদাবাজি

“তিন পার্বত্য জেলা থেকে বছরে চাঁদাবাজি হচ্ছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি।”

অস্ত্রধারীদের শক্তি ও সাম্প্রতিক উদ্ধার

২০২৫ সালে এ পর্যন্ত অন্তত পাঁচটি বড় অস্ত্র চালান জব্দ হয়েছে। বিভিন্ন অভিযানে বিপুল অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়েছে।

“চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি ইউপিডিএফ (মূল) দলের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় একটি ৪০ এমএম গ্রেনেড লঞ্চার, দুটি এম-১৬ রাইফেল, তিনটি একে-৪৭ রাইফেল, ১০টি গ্রেনেড, ১০ হাজার ৫০ রাউন্ড অ্যামুনেশন এবং ১৩টি ম্যাগাজিন... ১২ ফেব্রুয়ারি জেএসএস (মূল) দলের সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে পাওয়া যায় দুইটি একে-৪৭ অ্যাসল্ট রাইফেল, পাঁচটি মার্কিন তৈরি এম-৪ কার্বাইন, ২০টি ম্যাগাজিন, ৫০৪ রাউন্ড ৭.৬২ মি.মি. অ্যামুনেশন ও ৪ হাজার ৬৭৫ রাউন্ড ৫.৫৬ মি.মি. অ্যামুনেশন।”

অস্ত্র জমা না দেওয়া ও সন্ত্রাসের পুনরুত্থান

“চুক্তি বাস্তবায়নে ঘ খণ্ডের ১৩ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকারের সঙ্গে জেএসএসের চুক্তি স্বাক্ষরের ৪৫ দিনের মধ্যে অস্ত্র জমাদানের জন্য দিন, তারিখ ও স্থান নির্ধারণ এবং সদস্যদের তালিকা দাখিল করার কথা। এটি এখন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়নি এবং জেএসএসের সব অস্ত্র সমর্পণ করা হয়নি। ফলে পাহাড়ে অস্থিরতা এবং শান্তি স্থাপন সম্ভব হচ্ছে না।”

সশস্ত্র সংঘর্ষে এখন পর্যন্ত প্রাণ গেছে ৪২ জন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের, আহত হয়েছেন ১১১ জন।

অস্ত্রবাহিনীর পরিসংখ্যান

“পার্বত্য চট্টগ্রামে চারটি আঞ্চলিক সংগঠনের সশস্ত্র গ্রুপের রয়েছে আর্ম ক্যাডার ও সেমি আর্ম ক্যাডার বাহিনী। এর মধ্যে আর্ম ক্যাডারের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। অন্যদিকে সেমি আর্ম ক্যাডারের সংখ্যা ১০ হাজারের বেশি। সেমি আর্ম ক্যাডাররা অস্ত্রে প্রশিক্ষিত... এসব সন্ত্রাসীর কাছে কয়েক হাজার আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে।”

ভারতের মাটিতে ষড়যন্ত্র

পালিয়ে যাওয়া জেএসএস নেতা করুনালংকার ভান্তে নাম বদলে মনোগীত জুম্ম নামে নয়াদিল্লিতে বসবাস করছেন। তিনি এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় ‘স্বঘোষিত জুম্মল্যান্ড নেতা’।

“সম্প্রতি সরকারকে দেওয়া এক নিরাপত্তা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।”

এছাড়া, জেএসএস নেতা সন্তু লারমার সাম্প্রতিক ভারত সফর নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন।

“চিকিৎসার নামে ভারতে গেলেও তিনি কোনো ডাক্তার দেখাননি বা হাসপাতালে ভর্তি হননি। সরাসরি দিল্লিতে গিয়ে ওঠেন মনোগীত জুম্মর বাড়িতে। সেখানেই কয়েকদিন অবস্থান করেন তিনি... সেখানেই পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগে পার্বত্য এলাকায় অস্থিরতা সৃষ্টির নতুন ছক তৈরি হয়েছে।”

জেএসএসের নতুন পরিকল্পনা: ক্যাম্পাস টার্গেট

“পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে বিভ্রান্ত করে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্থিরতা তৈরির পরিকল্পনাও রয়েছে তাদের... গত ২৬ জুন রাঙামাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দেয় জেএসএস সদস্যরা।”

অস্ত্র প্রশিক্ষণ

প্রাপ্ত ৭০০ সদস্য

২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার তত্ত্বাবধানে ৭০০ জেএসএস সদস্য প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছে।

“১২ ফেব্রুয়ারি মিজোরামের লুংলাইতে তিন জেএসএস সদস্য অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয়।... ৩ জুন ভারতের ত্রিপুরা থেকে আরো ১৩ জেএসএস সদস্য আটক হয়, যারা চিকিৎসার কথা বলে ভারতে গিয়ে ত্রিপুরার বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের তত্ত্বাবধানে অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন।”

বিশেষজ্ঞ মত

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. ছালেহ শাহরিয়ার বলেন—

“পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশ কয়েকটি সশস্ত্র সংগঠন আছে। কিন্তু এর মধ্যে বর্তমান বাস্তবতায় জেএসএস জাতীয় নিরাপত্তার জন্য সবচেয়ে বেশি হুমকি। কারণ এ সংগঠনটির সঙ্গে পতিত আওয়ামী লীগের ভালো সম্পর্ক। এ ছাড়া ভারতের সঙ্গেও তাদের রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। তাই বাংলাদেশের পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও ভারত যদি অস্থিরতা তৈরির মিশনে নামে, তবে জেএসএসকে সবচেয়ে সহজে ব্যবহার করতে পারবে।”

 চুক্তির ২৭ বছর পরও অনিশ্চয়তা

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর স্বাক্ষরিত শান্তিচুক্তির ২৭ বছর পেরিয়ে গেলেও পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি আজও অধরা। চুক্তি বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং অস্ত্র সমর্পণে অনীহার কারণে অস্ত্রের রাজত্বে চলছে ‘জুম্মল্যান্ড’ গঠনের ষড়যন্ত্র।