২৫ জুলাই ২০২৫, ০১:৪৯ পি.এম

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আরও নজর দেওয়া প্রয়োজন

শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে আরও নজর দেওয়া প্রয়োজন

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়বে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ কমেছে। এ দুটি খাত বরাবরই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে। চলতি অর্থবছরের এডিপির চেয়ে আগামী অর্থবছরের এডিপিতে শিক্ষায় বরাদ্দ কমছে। বাজেট তৈরির প্রক্রিয়ায় যে গতানুগতিকতা কিংবা আমলাতান্ত্রিকতা আমরা এত দিন দেখে আসছিলাম, সেই ধারাবাহিকতার একটা প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি।

তবে বাস্তবতা হলো, এবারও ভিন্নভাবে বাজেট তৈরির চেষ্টা দেখা গেল না। বাজেট যারা প্রণয়ন করেছেন, তারা একদিকে উচ্চাভিলাষী পথটা পরিহার করেছেন। বাস্তবতার মধ্যে বাজেট তৈরি করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে যে বরাদ্দ কমানো হলো, সেই বার্তাটাও মানুষের মধ্যে যাচ্ছে। এটা সত্যি যে, উচ্চাভিলাষী বাজেট তৈরি করার মতো সম্পদের বাস্তবতা আমাদের নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে সম্পদের স্বল্পতার মধ্যে বাজেট করতে হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে একটা বিশাল পরিবর্তন হয়েছে। জনমানুষের আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রেও বিশাল একটা প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষাটা হচ্ছে গুণগত মানের দৃষ্টিকোণ থেকে বাজেটে একটু ভিন্ন ধরনের উদ্যোগ থাকা। কিন্তু আমরা সেটা দেখিনি। 

এবারের বাজেটে সম্পদের স্বল্পতার কথা মাথায় রেখে ভিন্ন ধরনের সংকেত দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের যে অবকাঠামো প্রকল্পগুলো বাদ দেওয়া হয়েছে, সেই অর্থ অন্য কাজে ব্যয় করার সুযোগ ছিল। যেমন প্রাথমিকে বৃত্তির একটা প্রকল্প আছে। ২০০৪ সালে প্রকল্পটি চালু হয়। মাসে ১০০ টাকা করে দেওয়া হয়। এটার একটা পরীক্ষিত বিতরণ পদ্ধতিও আছে, যেখানে তুলনামূলকভাবে অব্যবস্থাপনাগত অপচয়ও কম।

এখানে যদি ১০০ টাকার বদলে ৫০০ টাকা করে দেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু মানুষকে গুরুত্বপূর্ণ সংকেত দেওয়া যেত। প্রকল্পের বিন্যাসগুলোকে বদলেই সেটা করা সম্ভব হতো। সীমিত সম্পদের মধ্যেও সরকার যে ব্যতিক্রমীভাবে বরাদ্দের বিন্যাসটা সাজানোর চেষ্টা করছে, সেটা মানুষ বুঝতে পারত। কিন্তু সেই প্রচেষ্টা আমরা সেভাবে দেখতে পাচ্ছি না। অন্তর্বর্তী সরকারের নীতিনির্ধারক,বিশেষ করে বাজেট যারা তৈরি করছেন, তাদের মধ্যে দুর্নীতি ঠেকানোর চিন্তাটা ক্রিয়াশীল আছে। দুর্নীতি ঠেকানোর একটা পদ্ধতি হিসেবে তারা প্রকল্প কমানোর পথ বেছে নিয়েছেন। এ চিন্তার পেছনে আমাদের নাগরিক সমাজেরও এক ধরনের দায় আছে। 

এবারের বাজেটে বরাদ্দের যে বিন্যাস সেটা প্রথাগত ঐতিহ্যেরই প্রতিফলন। শিক্ষা খাতে ৯১টি প্রকল্প ও স্বাস্থ্য খাতের ৩৫টি প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পগুলো মূলত অবকাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প। আমাদের বাজেটে সাধারণত অবকাঠামো খাতগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সামাজিক খাতগুলোকে কম গুরুত্ব দেওয়া হয়। আমরা শিক্ষা বাজেট ও স্বাস্থ্য বাজেট বলি। কিন্তু বাস্তবতা বিবেচনায় এগুলোকে বলা দরকার শিক্ষা অবকাঠামো বাজেট ও স্বাস্থ্য অবকাঠামো বাজেট। কেননা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বাজেট আর অবকাঠামো নির্মাণ সমার্থক হয়ে গেছে। বাজেট প্রক্রিয়া প্রণয়নে যারা যুক্ত থাকেন, তাদের মধ্যে প্রচণ্ড একটা আগ্রহ থাকে নতুন অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের প্রতি। তৃণমূল পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা যে দুর্বল অবস্থায় আছে, তার অন্যতম কারণ জনবল ঘাটতি।

পদের বিপরীতে প্রায় যতগুলো পদ খালি আছে, সেই শূন্য পদে নিয়োগের জন্য যদি আলাদা একটা উদ্যোগ নেওয়া হতো, তাহলে কিন্তু মানুষের মধ্যে ইতিবাচক একটা সংকেত যেত। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ কমিয়ে আনাটা একমাত্র সংকেত হতে পারে না। এটা গ্রহণযোগ্য নয়। বাজেট প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় দুর্নীতি যদি কমাতে হয়,তাহলে ব্যয় দক্ষতার বিষয়টা কতটা আমাদের উন্নয়ন কার্যক্রম বা বাজেট সাজানোয় দুর্নীতি কমানোটা অবশ্যই একটা বড় বিষয়। আমাদের বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে যারা জড়িত, তারা মাঠ বাস্তবতা ভালো করে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বাজেট বরাদ্দ কমে যাওয়াটা হতাশার বিষয়। অবকাঠামো খাতের সঙ্গে তুলনামূলক বিচারে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে কতটা বরাদ্দ কমল, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। কিন্তু প্রকল্প বিন্যাসের জায়গায় এক ধরনের উদ্ভাবনী চিন্তা দেখানোর সুযোগ ছিল। বাজেটের চেয়েও শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সংস্কার ও গভর্ন্যান্স গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে সরকারের মনোযোগের ঘাটতিটা দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য খাত সংস্কারে কমিশন করা হলেও শিক্ষা সংস্কারে কমিশন করেনি।

অর্থনীতির আকারের তুলনায় শিক্ষা খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দের দেশগুলোর একটি বাংলাদেশ। আবার মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম খরচ করি আমরা। এটা সত্যি, রাতারাতি এ ধারায় পরিবর্তন আসবে না। আমাদের সম্পদ কম। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের ঋণের শর্তের বাস্তবতাও আছে। সে কারণেই বাজেট প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক ধরনের রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে। সরকার মূলত সীমিত সম্পদ, দুর্নীতি কমানো ও আইএমএফের চাপে এ রক্ষণশীলতার পথে হাঁটছে। দুর্নীতির নানা চেহারা আছে।

কিছু চেহারা যেটা আছে, সেটাকে আমরা সরাসরি দুর্নীতি হিসেবে চিনি। যেমন ঘুষ, আর্থিক লেনদেন ইত্যাদি । কিন্তু কিছু চেহারা আছে, সেটাকে ঠিক দুর্নীতি বলা যাবে না। সেটা হচ্ছে অদক্ষ প্রকল্প নির্বাচন ও ব্যয় দক্ষতার ঘাটতি। এ দুটি বিষয় কিন্তু দুর্নীতির সমগুরুত্বের অথবা তার চেয়েও বড়। আমি প্রাথমিক শিক্ষায় বৃত্তি বাড়ানো ও স্বাস্থ্যে জনবল বাড়ানোর দুটি উদাহরণ দিয়েছি। এ রকম কিছু করা গেলে সেটা মানুষের মধ্যে ইতিবাচক বার্তা দেবে। প্রতীকী পদক্ষেপ হিসেবেও এ ধরনের উদ্যোগ থাকতে হবে। 

দ্বিতীয়ত, বাজেটের ন্যারেটিভে গতানুগতিক আমলাতান্ত্রিকতা এবং আইএমএফের বাধ্যবাধকতার বাইরে বেরিয়ে মূল সমস্যাটা সঠিকভাবে অনুধাবন করা গেল কি না, তার একটা উপস্থিতি অবশ্যই থাকতে হবে। বাজেটে বরাদ্দ নিয়ে এদিক-সেদিক করণীয় করার খুব বেশি সুযোগ নেই। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে বরাদ্দ কমানোটাই একমাত্র বার্তা যেন না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। একই সঙ্গে জনআকাঙ্ক্ষাকে মাথায় রেখে প্রকল্প বিন্যাসে নতুন কিছু করার যে চেষ্টা করা হয়েছে, বাজেটে তার প্রতিফলন থাকা অবশ্যই দরকার ।

লেখক: সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান