আল জাজিরার আই-ইউনিট নামক অনুসন্ধানী দল সরকারের গোপন নজরদারি সংস্থা ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) কর্তৃক রেকর্ড করা একাধিক ফোনালাপ বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।
১৮ জুলাইয়ের একটি ফোনালাপে শেখ হাসিনাকে বলতে শোনা যায়—
“আমি তো আগে থেকেই নির্দেশ দিয়ে দিয়েছি। এখন ওরা প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করবে, যেখানেই পাবে, সেখানেই গুলি করবে। আমি তো এতদিন থামিয়ে রেখেছিলাম... ছাত্রদের কথা ভাবছিলাম।”
তিনি আরও বলেন—
“যেখানে জটলা দেখবে, ওপর থেকেই—এখন ওপরে থেকেই হচ্ছে—এরই মধ্যে কয়েক জায়গায় শুরু হয়ে গেছে। কিছু [বিক্ষোভকারী] নড়েছে।”
এই বক্তব্য রাষ্ট্রীয় শক্তির ব্যবহারের এক ভয়াবহ দৃষ্টান্ত। কোনো বিচারিক বা প্রশাসনিক যাচাই ছাড়াই একপ্রকার ‘খোলা লাইসেন্স’ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল হত্যার।
সরকার ও সেনাবাহিনী বারবার হেলিকপ্টার থেকে গুলি চালানোর অভিযোগ অস্বীকার করলেও পপুলার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে পাওয়া তথ্য অন্য কথা বলে। জরুরি বিভাগের চিকিৎসক শাবির শরীফ আল জাজিরাকে জানান—
“হেলিকপ্টার থেকে আমাদের হাসপাতালের প্রবেশপথ লক্ষ্য করে গুলি চালানো হয়েছিল।”
তিনি আরও বলেন—
“বেশিরভাগ বুলেট কাঁধ বা বুকে ঢুকেছে এবং শরীরেই থেকে গেছে... বুলেটগুলো অনেক বড় ছিল।”
এমন গুলির আকার ও প্রবেশপথ স্পষ্টভাবে ইঙ্গিত দেয় যে, এগুলো ছিল উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন, সম্ভবত সামরিক ব্যবহারের উপযোগী বুলেট।
১৬ জুলাই, রংপুরে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাত্রনেতা আবু সাঈদ। এই ঘটনাকে আন্দোলনের মোড় ঘোরানো মুহূর্ত হিসেবে চিহ্নিত করেন বিশ্লেষকেরা। পরবর্তী তদন্তে উঠে আসে ভয়ংকর তথ্য।
শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এক গোপন ফোনালাপে তৎকালীন আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুনকে বলেন—
“অটোপসি রিপোর্ট পেতে এত দেরি হচ্ছে কেন? রংপুর মেডিকেল কী লুকোচুরি খেলছে?”
রংপুর মেডিকেলের চিকিৎসক ডা. রাজিবুল ইসলাম জানান—
“আমাকে পাঁচবার পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাল্টাতে বাধ্য করে পুলিশ, যেন একাধিক গুলিবিদ্ধের উল্লেখ না থাকে। তারা চেয়েছিল রিপোর্টে লেখা হোক—সাঈদ ভাই পাথরের আঘাতে মারা গেছেন।”
এখানে স্পষ্ট হয়, সরকার শুধু গুলি চালায়নি, বরং তার প্রমাণও গোপন করার চেষ্টা করেছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (ICT) জানিয়েছে, জুলাই মাসে সংঘটিত দমন-পীড়নে প্রায় ১,৪০০ জন নিহত এবং ২০,০০০ জন আহত হন। এ পরিপ্রেক্ষিতে শেখ হাসিনা, তাঁর দুই মন্ত্রী ও নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ গঠন করা হয়েছে।
প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন—
“অন্যদের জন্য উনি অনেক গভীর গর্ত খুঁড়েছিলেন, এখন সেই গর্তেই তিনি নিজেই পড়ে গেছেন।”
এ কথা শেখ হাসিনার অতীত রাজনৈতিক চাল-চাতুরির প্রতি ইঙ্গিত করলেও ভবিষ্যতের জন্য এটি এক সতর্কবার্তা হিসেবেও ধ্বনিত হয়।
গোপন ফোনালাপ বিশ্লেষণ করে আরও দেখা গেছে, শেখ হাসিনা কেবল বিরোধী দল নয়, নিজের দলের নেতাদেরও এনটিএমসির মাধ্যমে নজরদারির আওতায় রেখেছিলেন। ফোনে একাধিকবার তাঁকে বলতে শোনা যায়—
“জানি, জানি, এটা রেকর্ড হচ্ছে, কোনো সমস্যা নেই।”
এ ধরনের আত্মবিশ্বাস কিংবা অযত্ন, যে সেটি তাঁর নিজের পতনের পথ তৈরি করছিল—তাও তিনি বুঝতে পারেননি।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ১৫ বছরের ক্ষমতাকাল শেষে যে ধরনের রাজনৈতিক ও নৈতিক ধসের মধ্য দিয়ে বিদায় নেয়, তা শুধু বাংলাদেশের গণতন্ত্র নয়, দক্ষিণ এশীয় রাজনীতির জন্যও একটি গভীর সতর্ক সংকেত। আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছিল কোটা সংস্কার নিয়ে। কিন্তু আন্দোলন দমন করতে গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহার করে যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়েছে, তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। বরং এটি একটি “রাষ্ট্রীয় হত্যাযজ্ঞ”—যার দায়ভার ব্যক্তির পাশাপাশি পুরো শাসনব্যবস্থার।