বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য নতুন পোশাকবিধি জারি হওয়ার পর থেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ একে প্রয়োজনীয় ও প্রশংসনীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখছেন। তারা বলছেন, দেশীয় নীতি-নৈতিকতা ও মূল্যবোধের সাথে যায় না এমন অশালীন ওয়েস্টার্ন পোশাক পরিহার করাই উচিত। বাঙালি সংস্কৃতির সাথেও ওয়েস্টার্ন লেগিংসজাতীয় পোশাক যায় না। দেশীয় সংস্কৃতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে পশ্চিমা পোশাক পরিধানের বিষয়টি অগ্রহণযোগ্য বলে মন্তব্য করে তারা। এদিকে, সেক্যুলার ঘরানার লোকজন এটিকে স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ এবং লিঙ্গবৈষম্যের নজির বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে এই আলোচনা ও সেক্যুলারদের বিরূপ মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংশ্লিষ্ট নির্দেশনাটি প্রত্যাহার করে নিয়েছে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের নির্দেশে তা বাতিল করা হয়।
ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ ব্যাংকে কর্মরত সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় অফিস চলাকালীন পেশাদার ও মার্জিত পোশাক পরিধানের বিষয়ে বিভাগীয় সভায় আলোচনা করে পরামর্শ দেওয়া হয়, তবে এই বিষয়ে কোনো নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি এবং কোনো সার্কুলারও জারি করা হয়নি।
মিডিয়ায় বিষয়টি প্রচারিত হলে তা বিদেশে অবস্থানরত গভর্নরের নজরে আসে এবং তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তাঁর নির্দেশে এই মুহূর্তে বিষয়টি প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এর আগে বিষয়টি গণমাধ্যমে উঠে এলে তা নিয়ে নানান মতামত প্রকাশ পেতে থাকে। তোফায়েল খান নামে একজন মন্তব্য করেন, "খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।" অন্যদিকে আশা জাহিদ লিখেছেন, "বাংলাদেশ ব্যাংকের হাজারটা কাজ ফেলে এখন কী পোশাক পরবে, সেটা ঠিক করা নাকি জরুরি?"
শরিফুল হাসান বলেন, "ব্যক্তিগত জীবনের পোশাক ঠিক করে না দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ, তবে অফিসে শালীন পোশাকের পরামর্শ ভালো উদ্যোগ।"
সাদ রহমান মন্তব্য করেন, "এ ধরনের নির্দেশনা শুধু মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনই নয়, বরং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে লিঙ্গবৈষম্য প্রতিষ্ঠা করে।"
বুধবার (২৩ জুলাই) দিবাগত রাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান এক বিবৃতিতে বলেন, "পোশাকবিধির সার্কুলারটি একটি পরামর্শমূলক নির্দেশনা।"
তিনি আরও জানান, "বিভিন্ন বয়সী কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে পোশাকের বৈচিত্র্য এবং মানসিক দূরত্ব কমিয়ে পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধির লক্ষ্যেই এই সার্কুলারটি জারি করা হয়েছে।"
তার ভাষ্য, "এতে বোরকা বা হিজাব পরিধানে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, বরং অতিরিক্ত কারুকাজযুক্ত পোশাক নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। এর ফলে অফিসে কারো পোশাকের স্বাধীনতা খর্ব হবে না।"
উল্লেখ্য, সোমবার (২১ জুলাই) বাংলাদেশ ব্যাংকের মানবসম্পদ বিভাগ-২ থেকে একটি অফিস নির্দেশনায় পোশাক সংক্রান্ত কিছু সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করা হয়, যা বিভাগীয় মাসিক সভার এজেন্ডা ও কার্যবিবরণীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল।
নির্দেশনার ১১ (ঘ) নম্বরে বলা হয়, "বাংলাদেশ ব্যাংকের সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের (সি ও ডি শ্রেণিভুক্ত কর্মচারীদের নির্ধারিত পোশাক ব্যতীত) সামাজিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় পেশাদার ও মার্জিত পোশাক পরিধান করতে হবে। যেমন—পুরুষ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ক্ষেত্রে ফরমাল শার্ট, লম্বা হাতা বা হাফ হাতা, ফরমাল প্যান্ট, ফরমাল জুতা পরতে হবে। জিনস ও গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরিহার করতে হবে।"
নারী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য বলা হয়, "শাড়ি, সালোয়ার-কামিজ ও ওড়না, অন্যান্য পেশাদার শালীন পোশাক অবশ্যই সাদামাটা এবং পেশাদার রঙের হতে হবে। ফরমাল স্যান্ডেল বা জুতা, সাদামাটা হেডস্কার্ফ বা হিজাব হতে হবে। শর্ট স্লিভ ও লেংথের ড্রেস (ছোট হাতা ও দৈর্ঘ্যের পোশাক), লেগিংস পরিহার করতে হবে।"
একই নির্দেশনার ১১ (ক) নম্বরে বলা হয়, "নারী কর্মীদের প্রতি আচরণের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক স্টাফ রেগুলেশন ২০০৩-এর ৩৯ ধারায় বর্ণিত নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। যৌন হয়রানিসংক্রান্ত অভিযোগগুলো ঘটনা ঘটার ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে মানবসম্পদ বিভাগ ১–এর নির্দিষ্ট পরিপত্রের মাধ্যমে গঠিত কমিটির কাছে পাঠাতে হবে।"
১১ (খ) নম্বরে উল্লেখ রয়েছে, "সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের বিষয়ে মানবসম্পদ বিভাগ ২-এর অফিস নির্দেশ যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে।"
১১ (গ) নম্বরে বলা হয়, "ইতিবাচক কর্মপরিবেশ তৈরি করার জন্য দাফতরিক শিষ্টাচার ও আচরণবিধি তথা সততা, নৈতিকতা, সময়ানুবর্তিতা, শৃঙ্খলাবোধ, অর্পিত দায়িত্ব-কর্তব্য পালনে নিষ্ঠা ইত্যাদি, সহকর্মীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আচরণ ও আন্তরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক (পারস্পরিক সম্মান, সৌজন্যবোধ, সহযোগিতামূলক মনোভাব ইত্যাদি) মেনে চলতে হবে।"
পরিশেষে, সিদ্ধান্তের ১২ নম্বরে বলা হয়, "১১ নম্বর ক্রমিকে দেওয়া নির্দেশনা পরিপালনের জন্য অফিস, বিভাগ, প্রকল্প, সেল, ইউনিটভিত্তিক পর্যবেক্ষণের জন্য একজন কর্মকর্তাকে মনোনয়ন দিতে হবে। ওই নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না, সে বিষয়ে তদারকি করবেন মনোনীত কর্মকর্তা। এর ব্যত্যয় হলে বিভাগীয় প্রধানকে অবহিত করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে নির্দেশনা ও শৃঙ্খলাভঙ্গের বিষয়ে অভিযোগ পাঠাবেন।"